২০১৯ শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই সময়মতো সরবরাহ ও শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় অক্টোবরের মধ্যেই পাঠ্যবই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উপরোল্লিখিত সমস্যার কারণে এনসিটিবি এবার সময়ক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়তে পারে।
পত্রপত্রিকা ও এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের বই ছাপা হবে ১১ কোটির মতো। বই ছাপার জন্য ৫ মার্চ টেন্ডার আহ্বান করে ১২ এপ্রিল দরপত্র খোলা হয়। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি বৈঠকে টেন্ডার বা দরপত্র চূড়ান্ত করতে পারেনি। কারণ টেন্ডারে কাগজের যে মূল্য ধরা হয়েছে, তাতে মাধ্যমিকের কাগজের চেয়ে বেশি দর ধরা হয়েছে। এতে বিগত বছরের চেয়ে কাগজের দাম বেশি হবে। এই একটিমাত্র কারণে মূল্যায়ন কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।
একাংশ চাইছে পিপিআরের নীতিমালার আলোকে বিদ্যমান টেন্ডার পুনর্মূল্যায়ন করতে। আরেক অংশ চাইছে সম্পূর্ণ নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে; কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কাগজের দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি মেট্রিক টন ৯৫ হাজার টাকা, আর প্রাথমিকের প্রাক্কলন করেছে ৮২ হাজার টাকা।
তবে মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিকের বইয়ের কাগজের মান ও উজ্জ্বলতা সমান হয় না। সেক্ষেত্রে প্রাথমিকের কাগজের দাম বেশি হতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রাক্কলন দর কমানোর পেছনে কোনো রহস্য কাজ করেছে। সে রহস্যটি হচ্ছে, টেন্ডার ফেলা ও বাছাইয়ের সময়ই বিদেশি একাধিক দরপত্র বাতিল হয়ে গেছে। এখন নতুন করে টেন্ডার হলে বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে পারে।
পার্শ্ববর্তী দেশের ‘প্রিতাম্বার’ ২০১৬ সালে প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর অন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পায়। কিন্তু জিনিস সরবরাহ করেছিল নির্ধারিত সময়ের চার মাস পর। ফলে এনসিটিবি প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। শোনা যাচ্ছে, ওই প্রতিষ্ঠানটি ফের কাজ পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে এবং এনসিটিবির উচ্চ পর্যায়ের দু-একজন কর্মকর্তাও তাদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আগামী শিক্ষাবর্ষে বইয়ের ব্যাপারে প্রতি ফরমা ছাপানো ও আনুষঙ্গিক দরসহ প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু টেন্ডারে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দর হেঁকেছে ২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ৯৩ পয়সা পর্যন্ত। গড়ে ২ টাকা ৭৫ পয়সা। এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। গেল বছর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকের বই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম দামে ১ টাকা ৯৫ পয়সায় ছেপেছিল।
প্রাথমিকে গড়ে ১২ দশমিক ৬৮ ফরমায় প্রতি বইয়ের দাম পড়বে ২৪ টাকা ৬৪ পয়সা। এবার সেই বই গড়ে ২ টাকা ৭৫ পয়সা দাম পড়েছে। এতে প্রতি বইয়ের দাম পড়বে ৩৪ টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি বই গেল বছরের চেয়ে ১০ টাকার বেশি দাম পড়ছে। এতে প্রায় ১১ কোটি বইয়ের জন্য ১১১ কোটি টাকা বেশি খরচ পড়বে। এ বছরের বইয়ের জন্য প্রাক্কলিত দর ৩৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইস্যুতে টেন্ডার কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে সংকট কাটিয়ে উঠতে তিনটি প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি হচ্ছে পিপিপির ৯৮ ধারা অনুযায়ী প্রাক্কলন করে দর বাড়ানো, পুনঃটেন্ডার আহ্বান করা, নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা। কয়েকজন নতুন টেন্ডারের পক্ষে মতামত দেন। দুজন তখন পাঠ্যবইয়ের কাজ সময়মতো শেষ করার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
তা হচ্ছে নতুন করে বা পুনঃটেন্ডার করলে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করলে অন্তত ৪২ দিন সময় লাগবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। এরপর মূল্যায়নে অন্তত ২০ জন লাগবে। এছাড়া দরদাতাদের কাজ দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে আরও ২৮ দিনের প্রক্রিয়া আছে। তাই কমিটির দুজন সদস্য ফের বাজার দর যাচাই শেষে বিদ্যমান টেন্ডারেই সমাধা করতে চান।
এনসিটিবি গেল বছরের চেয়ে এবার (২০১৮) ৬০ শতাংশ বেশি দরে মাধ্যমিকের কাগজ কিনেছে। সেখানে প্রাথমিকের টেন্ডারে দর গড় ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছর ‘নির্বাচনের বছর। এ অজুহাতে ছাপার কাগজের মূল্য টনপ্রতি ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী একটি চক্র ও দেশীয় সিন্ডিকেট মিলে এ কাজটি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার সঙ্গে যুক্ত দেশীয় মুদ্রণকারীরা। মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, বিশ্বব্যাপী কাগজ তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে কাগজের বাজারে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য সরকার প্রায় ৩৭ কোটি বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এনসিটিবি বই ছাপার জন্য যে মূল্য দিতে চায়, তা নিয়ে অসন্তোষ মুদ্রণকারীদের। তারা বলছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম, নিরাপত্তা পেপারের দাম, অন্যান্য মুদ্রণ উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি গেল বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এনসিটিবি যে দামে টেন্ডার আহ্বান করেছে, তাতে অংশ নিলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। মুদ্রাকরের নেতারা বলছেন, এনসিটিবি নিজেই ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে কাগজ কিনেছে। অথচ এনসিটিবি যখন টেন্ডার করছে, তখন কম মূল্যে নির্ধারণ করছে কাগজে। এ নিয়েই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
একই অবস্থা তৈরি হয়েছে জুলাই মাসে শুরু হওয়া উচ্চমাধ্যমিকের তিনটি বই নিয়ে। বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি। এ তিনটি বইয়ের টেন্ডারে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি। ৯৩টি টেন্ডার শিডিউল বিক্রি হলেও ৩ মে টেন্ডার বাক্স খোলার দিন দেখা গেল প্রায় ৩০ লাখ বই ছাপানোর জন এনসিটিবিতে কেউ টেন্ডার জমা দেয়নি। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন আরেক জটিলতা।
টেন্ডার প্রাক্কলনে বাংলা ও বাংলা সহজ পাঠের দাম বাড়ানো হলেও ইংরেজি বইয়ের দাম গেল বছরের দামেই অপরিবর্তত রাখা হয়েছে। দেশীয় মুদ্রণকারীরা এক্ষেত্রেও একই দাবি করে বলেছেন, কাগজসহ মুদ্রণ উপকরণের দাম বিগত বছরের চেয়ে বেড়েছে। এনসিটিবি এ বিষয়টিকে এড়িয়ে টেন্ডার ডেকেছে। তাই কেউ কেউ অংশ নেয়নি। উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পৌঁছানো যাবে কি না, তা এখন অনিশ্চিত। বাংলা বইয়ে এবার নতুন দুটি গল্প যুক্ত হবে।
এছাড়া ওই তিনটি বইয়ের বড় কোনো পরিবর্তন নেই। ফলে এত বিপুল পরিমাণ বইয়ের বাজার চাহিদাও নেই। বই বিক্রি না হলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে মুদ্রণকারীদের। উচ্চমাধ্যমিকের তিনটি বই— বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি শিক্ষার্থীদের মূল্য পরিশোধে কিনতে হয়। এবার বাংলা বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ১২১ টাকা, বাংলা সহজ পাঠের দাম ধরা হয়েছে ৫৯ টাকা আর ইংরেজি বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ৮১ টাকা। উচ্চমাধ্যমিক বাংলা, সহপাঠ ও ইংরেজি উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বাণিজ্য ও মানবিক শাখার সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক।
এ বই তিনটি বিনামূল্যে দেওয়া হলেও এনসিটিবির নির্ধারিত বই বাধ্যতামূলক। এ তিনটি বই এনসিটিবি নিজে ছাপায় না। মুদ্রণকারীদের কাছে স্বত্ব দিয়ে দেওয়া হয় এবং বইয়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে এনসিটিবি। বই তিনটি নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার জন্য দেশীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে কয়েক বছর থেকেই চলছে দ্বন্দ্ব। অর্ধশতাধিক ছাপা প্রতিষ্ঠানের মালিকের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ১৬৫টি ওয়েব মেশিন। চলতি বছর ৬৬টি ওয়েব মেশিন প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর অতিরিক্ত আরও ১৩টি ওয়েব মেশিন এতে যুক্ত হচ্ছে। এসব মেশিনে বই ছাপা-বাঁধাই ও প্যাটেকজাত হয়ে বের হয়।
ফলে অল্প সময়ে অধিক বই ছাপা যায়। অপরদিকে আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে এক হাজারের অধিক অফসেট প্রিন্টিং প্রেস। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রেস পাঠ্যবই ছাপার কাজে অংশ নেয়। এ দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েক বছর থেকে চলছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। অফসেট প্রিন্টিং প্রেস মালিকরা বলছেন, ওয়েব মেশিন মালিকরা সিন্ডিকেট গড়ে এনসিটিবির মাধ্যমে বইয়ের বড় লট তৈরি করে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে বড় লটের কাজ ভাগবাটোয়ার করে নেন। এদের ছাপার মান ভালো নয়। বই সময়মতো সরবরাহ করতে পারেন না। কয়েক বছর তারাই বই দিতে দেরি করছেন।
অপরদিকে ওয়েব মেশিন মালিকরা বলছেন, অফসেট মালিকদের কারণেই বই ছাপার কাজ ভারতীয় মুদ্রণকারীরা নিয়ে গেছেন। তারা ওয়েব মেশিনে বই ছাপিয়ে দ্রুত ও সময়ের আগেই বই সরবরাহ করেছেন। এছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশীয় মুদ্রণশিল্প এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি বলেন, এ বছর ৩৭ কোটি বই অফসেট প্রিন্টিং প্রেসে সারা বছর ছাপিয়েও সময়মতো সরবরাহ করা কঠিন হবে। এ কারণেই এনসিটিবি বই ছাপার কাজ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে চায়।
দেশাত্মবোধের চেতনা থেকেই মুদ্রণশিল্প মালিকরা অত্যাধুনিক ওয়েব মেশিন দেশে নিয়ে এসেছেন। টেন্ডারের শর্ত ও শিডিউলমতো বই সরবরাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না ২ বছর থেকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মুদ্রণশিল্পকে অবশ্যই আধুনিক করতে হবে। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
২০১৯ শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই সময়মতো সরবরাহ ও শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় অক্টোবরের মধ্যেই পাঠ্যবই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উপরোল্লিখিত সমস্যার কারণে এনসিটিবি এবার সময়ক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়তে পারে। বই সরবরাহ করতে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে এনসিটিবিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আর সেটি হচ্ছে এনসিটিবি প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বই ছেপে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়। এটি একটি দুরূহ কাজ। এ বিশাল কাজটি করার জন্য এনসিটিবির নিজেরই প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং মেশিন থাকা উচিত। তাতে বিদেশি এবং দেশি প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো সহজ হবে।
এড়ানো যাবে প্রায় প্রতি বছর সৃষ্ট এসব জটিলতা। আর সব বিভাগের পুস্তকের মান নিয়ন্ত্রণের জন্যও এনসিটিবির একটি বিশেষ ইউনিট থাকতে হবে, তা নাহলে শুধু লাখো কোটি বই ছাপানো আর বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব কী থাকল?
—মাছুম বিল্লাহ
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত
masumbillah65@gmail.com
0 Comments