উসাইন বোল্টের সাফল্যের ১০ সূত্র

 
 
 
 
 
অতিমানব, অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে উসাইন বোল্টের বর্ণনায়। জ্যামাইকার এই কিংবদন্তিকে বলা হয় ইতিহাসের দ্রুততম মানব। ২০১৭ সালে অবসর নেওয়ার আগে যতগুলো দৌড়ের প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছেন, সব ক্ষেত্রে শেষ দৃশ্যটা যেন অনুমেয়ই ছিল! বোল্ট ছুটবেন, জিতবেন, উৎসব করবেন! চারবার ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসম্যান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের দেওয়া সেরা পুরুষ অ্যাথলেটের পুরস্কারটা নিজের করে নিয়েছেন ছয়বার। বহু রেকর্ড বোল্টের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাঁর কাছে সাফল্যের সূত্রগুলো কী?

১. কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়
শুরুর দিকে আমি একাগ্রতা হারাতে চাইনি। তাই বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে বাসায় বসে নিজেকে সময় দেওয়াই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যখন আপনি আপনার সবটুকু ঢেলে দিয়ে নিজেকে তৈরি করবেন, তখন সন্ধ্যায় একটু বিশ্রাম আপনার প্রাপ্য। ‘আমি বাসায় থাকব। তোমরা যাও।’ বন্ধুদের এ কথা বলা কঠিন। তবু বন্ধুরা যখন ক্লাবে যেত, আমি থাকতাম বাসায়। আপনাকেও এই কাজটি করতে হবে। যদিও যখন কোনো প্রতিযোগিতা থাকত না, আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। ওদের সঙ্গে চলে যেতাম। কিন্তু এখন বুঝি, দিন শেষে ডিজের বাজনা আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাত।
২. হেরে যাওয়ার ভয়ই অনুপ্রেরণা
আমি কখনোই হেরে যেতে চাই না; স্বভাবতই আমার মনোভাব খুব প্রতিযোগিতামূলক। একজন পেশাদার ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় ভয়, এমনকি দৌড়ানোর সময়ও আমার একটি মাত্র ভয়ই কাজ করে। আর তা হলো হেরে যাওয়ার ভয়। এই ভয়টা সব সময়ই থাকবে। আর এই ভয়টা কাটানোর একমাত্র উপায় হলো অন্য যে কারও চাইতে কঠোর প্রশিক্ষণ, পরিশ্রম ও একাগ্রতা।
৩. ‘রোল মডেল’ থাকা জরুরি
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার ‘রোল মডেল’ ছিলেন মাইকেল জনসন এবং ডন কোয়ারি। জনসন ছিলেন বিশ্বসেরা দৌড়বিদ, বিশেষ করে ২০০ মিটার দৌড়ে (আমার প্রিয় ইভেন্ট)। আর কোয়ারি ইতিহাসে জ্যামাইকার সেরা স্প্রিন্টারদের মধ্যে একজন। আমি তাঁদের মতো হতে চেয়েছিলাম। এখনো এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, আমি যাঁদের মতো হতে চাই। এই মুহূর্তে আমার পছন্দের মানুষ হলেন কেভিন ডুরান্ট। তিনি একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড়। ওকলাহোমা শহরে থান্ডারের হয়ে খেলেন। কেভিন একজন ভালো নেতা। তিনি খুব শক্তিশালী এবং খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি যা-ই করেন না কেন, যদি ক্লান্ত হন বা আহতও হন, সেই অবস্থাতেও কখনো হাল ছাড়েন না। নিজেদের সেরাটা দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর দলের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করেন এবং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
৪. চাই সেরাদের সঙ্গ
আমার সাফল্যের রহস্যটা আসলে খুব সোজাসাপ্টা—আমি একটা সেরা দল পেয়েছি! হ্যাঁ, যা আমি করি তাতে আমার কঠোর চেষ্টা নিহিত থাকে, কিন্তু আশপাশের মানুষদের ছাড়া এটা আসলে সম্ভব হতো না। আমার পরিবার, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার কোচ—তাঁরা আমার সাফল্যের সহায়ক। বিশেষ করে আমার মা-বাবা সত্যিই অনেক সমর্থন দিয়েছেন। আমি যেন প্রশিক্ষণের জন্য যা যা করা দরকার তার সবটুকুই করি, এটা তাঁরা নিশ্চিত করতেন। আমি যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করি, তার ফলাফল যে ভালো হবে না, সেটা ছোটবেলা থেকেই জানতাম। বাবা খুব কড়া নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিলেন। তাই তাঁকে ভয় পেতাম। ছোটবেলায় এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলেই হয়তো আমি নিয়ম ভাঙার সাহস পাইনি।
৫. আনন্দে বাঁচি
সব সময় খেলাটা উপভোগ করো—জীবনে যত উপদেশ পেয়েছি, তার মধ্যে এটাই সেরা। কোন আমাকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন। আপনি যদি আনন্দ নিয়ে কাজ করেন, তবেই আসলে কাজে আপনার মন বসবে। আপনি আপনার কাজটা মনেপ্রাণে ভালোবাসবেন।
৬. উন্নতির শেষ নেই
আপনি যত ভালোই হন না কেন, নিশ্চয়ই আরও ভালো হওয়ার সুযোগ আছে। দৌড়ের ক্ষেত্রে যেমন শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি বেশ লম্বা (৬ ফুট ৫ ইঞ্চি) বলে দৌড়ানোটা আমার জন্য যত সহজ, শুরু করা ততটাই কঠিন। উচ্চতা বেশি বলে আমি লম্বা লম্বা পা ফেলতে পারি, এটা আমার জন্য খুব ভালো দিক। কিন্তু বেশি উচ্চতা দৌড় শুরুর জন্য ভালো নয়। শুরুটা করতে একটু সময় লেগে যায়। একটা ভালো শুরু রপ্ত করতে আমার অনেক সময় লেগেছে।
৭. আপনার আগ্রাসনকে নিয়ন্ত্রণ করুন
খেলাধুলার ক্ষেত্রে কেবল আক্রমণই যদি আপনার পরিকল্পনা হয়, তাহলে শেষটা হয়তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমি আক্রমণাত্মক মনোভাবে বিশ্বাস করি না। আমি কেবল শান্ত, সরল, স্থিরভাবে নিজের কাজটা করে যাই। কী হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করাটাই আমি পছন্দ করি। জীবনের কোনো অধ্যায়েই আমি জুয়ায় বিশ্বাসী নই এবং আমার মনে হয় আক্রমণাত্মক মনোভাব একধরনের জুয়া।
৮. আত্মতৃপ্তিতে ভুগবেন না
জ্যামাইকায় ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার দৌড়ে যখন স্বর্ণপদক পেলাম, সেটাই ছিল আমার জন্য সব চেয়ে গৌরবের মুহূর্ত। তখন বয়স মাত্র ১৫। সেই বয়সেই পেয়ে গেলাম দৌড়ের ইতিহাসে বিশ্বের সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ স্বর্ণপদকজয়ীর খেতাব। ঘটনাটা ওখানেই শেষ। আমি বিশ্ব রেকর্ড নিয়ে ভাবিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবিনি যে ‘আমি বিশ্বের দ্রুততম মানুষ’। আমি স্রেফ আবার প্রশিক্ষণে ফিরে গিয়েছি।
৯. ভেবেচিন্তে খরচ করুন
আপনি যা-ই করেন না কেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে বিনিয়োগ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি না জেনে থাকেন যে আপনি আসলে কী করছেন, তাহলে এমন কাউকে নিয়োগ করুন যিনি বিষয়টি বুঝতে পারবেন। আমার একজন অর্থ উপদেষ্টা আছেন। তিনি এবং আমার ম্যানেজার—এই দুজন মিলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। একটা জয় পেলে নিজেকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আমি নিজেকে কিছু উপহার দিই। সহজ করে বললে গাড়ি কিনি।
১০. প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করুন
প্রতিদ্বন্দ্বিতা আপনাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাবে। আজকাল আমি আমার তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাই না। কেউ কেউ অবশ্য খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। মনে আছে, কলেজের প্রথম বর্ষে একটি ছেলে আমাকে টক্কর দিয়েছিল। পরের বছর আমি আমার জীবনের সেরা পরিশ্রমটুকু করেছিলাম।

Post a Comment

0 Comments