মামুনুর রশিদ: একটি দেশ তথা একটি জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
আর এ শিক্ষার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষার গভীরে
না পৌঁছে কোনো জাতিই উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারেনি। আধুনিক যুগ
বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বায়নের মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের অবদান। আজকের ইউরোপিয়ান
কিংবা আমেরিকানরা বিজ্ঞানকে চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিনিয়ত
গবেষণা করে মানবকল্যাণে নিত্যনতুন আবিষ্কার করে চলেছে। একটু চিন্তা করলেই
এটা পরিষ্কার হবে, বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করেই মানুষ চন্দ্র বিজয় করেছে এবং
মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন সফলকামও হবে।
এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত জাপান, দক্ষিণ
কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব
নেতৃত্বে নিজেদের একটি সম্মানজনক আসনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব
দিতেই হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব ব্যতিরেকে জাতি হিসেবে আমরা
বিজ্ঞানমনস্ক এ দাবি করা যুক্তিহীন। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, এদেশকে
এগিয়ে নিতে হলে এ দেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় অধিক পরিমাণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ
করা একান্ত জরুরি। কিন্তু শিক্ষাবিষয়ক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সরকারি
প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের
(ব্যানবেইস) পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়।
১৯৯০ সালে
মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২ দশমিক ৮১
শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকে
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর ২০০২ সালে তা
বেড়ে হয় ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তারপর আবার পতনের শুরু এবং ২০১৩ সালে তা নেমে
আসে শতকরা ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক
সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের
(ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান
শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কমিশনের ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ। কিন্তু
বর্তমানে তা কমে হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ! পরিসংখ্যান বলছে, বিজ্ঞান
শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনদিন হতাশাজনকভাবে কমছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থী বাড়ছে
ব্যবসায় শিক্ষায়।
গত কয়েকবছরের পরিসংখ্যানে এটা সুস্পষ্ট
যে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিড় করছে বিজ্ঞানের বদলে ব্যবসায় শিক্ষায়। যেখানে
নব্বইয়ের দশকে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল
উল্লেখযোগ্য, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানভিত্তিক যুগে এসে তা প্রায় অর্ধেকে
নেমে এসেছে। চটকদার ডিগ্রি (বিবিএ/এমবিএ), করপোরেট জগতে মোহনীয় চাকরির
প্রলোভন আর আইনি খোলা দরজা দিয়ে বেনোজলের মতো ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ঢুকছে
সম্ভাব্য বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা। ব্যবসায় শিক্ষা অধ্যয়নও দরকারি কিন্তু
মানবজীবনের জন্য বিজ্ঞানের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো দেশ বা জাতির
উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো বিজ্ঞান শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও আজ আমাদের দেশে কেন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি
ক্রমবর্ধমান অনীহা দেখা যাচ্ছে? কেন স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যায়েও বিজ্ঞান অধ্যয়নের পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না? কী কী
কারণে বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী কমছে এবং ব্যবসায় শিক্ষায় বাড়ছে তা অনুসন্ধান
করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি এর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভিঘাত অনুসন্ধান করা।
বিজ্ঞান পঠন-পাঠন অপেক্ষাকৃত কঠিন। সাধারণত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়
ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে স্কুলের
বাইরেও তাদের আলাদাভাবে সেই বিষয়ে প্রাইভেট টিউটর রাখা কিংবা কোচিংয়ে পড়তে
হয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের একজন বিজ্ঞানের ছাত্রের পেছনে শিক্ষা বাবদ বেশি
ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে অনেক পিতামাতা ভেবে থাকেন অযথাই বিজ্ঞান পড়ে এত
কষ্ট করার চেয়ে অন্যান্য শাখায় খুব সহজেই ভালো ফলাফল করা যায়। তাই তাদের
আর্থিক সক্ষমতা কিংবা সন্তানের পরিশ্রম করার মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে
বিজ্ঞানে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী। সিলেবাস এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা।
বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য যে, ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের তুলনায় বিজ্ঞান
বিষয়গুলোর সিলেবাস প্রায় তিন গুণ বড়! সিলেবাসপ্রণেতারা আমাদের মতো তরুণ
বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সিলেবাস প্রণয়ন
করেননি। বর্তমান সিলেবাস দেখলে মনে হচ্ছে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক
পর্যায়েই একেকজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে তাঁরা আইনস্টাইন বানাতে চান। একজন
তরুণ শিক্ষার্থী যখন কোন একটি বিষয় ঠিক মত বুঝতে পারে না, পড়ার মাঝে যখন সে
আনন্দের পরিবর্তে বিশাল বোঝা খুঁজে পায় তখন সে আস্তে আস্তে ঐ বিষয় থেকে
দূরে সরে যেতে চায়। এমন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আছে, যারা কিনা মাধ্যমিকে
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সে বিজ্ঞান বিভাগের কাঠিন্যে,
উচ্চমাধ্যমিকে আর বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছে না। তার ধারণা, বিজ্ঞান
বিভাগে পড়াশুনা করা অনেক বেশি কষ্টের, অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা যখন তার
অর্ধেক সময় পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল করছে অথচ সে তাদের চেয়ে মেধাবী হয়েও এবং
বেশি পড়াশুনা করেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছে না! বর্তমানে মাধ্যমিক এবং
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি
প্রণয়ন করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ইহা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কিন্তু প্রতিটি
পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে সুকৌশলে পৃষ্ঠা সংখ্যা
কমিয়ে আনলেও প্রতিটি অধ্যায়ে অনুশীলনীমূলক কাজ দিয়ে সিলেবাসকে আগের চেয়ে
প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে! অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন পদ্ধতিতেও আনা হচ্ছে জটিলতা।
এমন অনেক বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য হওয়া
সমীচীন।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার মূল কারণ
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিকূলতা, বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞান
শিক্ষকের অপ্রতুলতা, ত্রুটিযুক্ত অসামঞ্জস্য শিক্ষাদান পদ্ধতি, ভারসাম্যহীন
সিলেবাস, অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বইয়ের অভাব
ইত্যাদি। বিজ্ঞান শিক্ষকদেরও এখন আর বিজ্ঞান সাধক বলা যায় না, তাঁদের
অনেকেই এখন ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন! ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে বাইরে প্রাইভেট পড়াতেই
তাঁরা বেশি আগ্রহী? তাঁদের কারণে বিজ্ঞানের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে অপার
কৌতুহল নিয়ে চর্চায় আগ্রহী না হয়ে শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে নম্বর কিনে
নিচ্ছে? তাই তাঁদের কাছে বিজ্ঞান আর জ্ঞান রইল না, হয়ে উঠছে পণ্য। আরও একটি
কারণ হচ্ছে, বিজ্ঞানের শিক্ষককে ক্লাস ছাড়াও আলাদা ব্যবহারিক ক্লাস করতে
হয়। ছাত্র জীবনে যাকে ক্লাস শেষে বা ক্লাসের আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে ব্যবহারিক ক্লাসে কাজ করতে হয়েছে, আজ কর্মক্ষেত্রে তার আলাদা কোনো
মর্যাদা নেই। অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য আলাদা কোনো সম্মানীও নেই। এগুলো
দেখার যাদের চোখ আছে, যারা বোঝে তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান পড়াতে আগ্রহ
সৃষ্টি করবে কিনা সন্দেহ আছে।
তাই এখনই যদি, বিজ্ঞান
শিক্ষার প্রতি নজর দেয়া না হয় তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা
ভেঙে পড়বে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যত রকম প্রচেষ্টাই নেয়া হোক না কেন,
বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে তা কখনই সম্ভব
হবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে বিজ্ঞান বিষয়কে আরও আকর্ষণীয় করতে
হবে এবং বিজ্ঞানে চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী ও তরুণদের বিজ্ঞানের
প্রতি আগ্রহী করতে চাইলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে
হবে। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। আমাদের
স্বপ্ন দেখাতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এই ক্রমাবনতির
হার এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যা একটি জাতির পঙ্গুত্বের
পূর্বাভাস। এই দুষ্টচক্র থেকে এখনই উত্তরণ না ঘটলে জাতির কপালে ঘোর
অমানিশার অন্ধকার অবধারিত। তাই একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থী হিসাবে বিজ্ঞান
শিক্ষার এ বেহাল দশার প্রতি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলের সুনজর কামনা করছি।
n লেখক :গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
mamunurrashidmiajee@gmail.com
0 Comments