বেচাকেনার আদব কানুন

কোনো সমাজের সংশোধন নাগরিক ও জনগণের দ্বারাই হয়ে থাকে। সবাই করছে তাহলে আমি একা এর বিপরীত করে কী করবÑ এটা মনে করা শয়তানের ধোঁকা। অন্যরা যা ইচ্ছা তা-ই করুক, আমার তো সে দিকে ভ্রƒক্ষেপের
কোনো দরকার নেই

হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা দয়াবর্ষণ করেন ওই ব্যক্তির ওপর যে বিক্রি, ক্রয় এবং নিজের হক উসুল করার সময়ও নরম আচরণ করে থাকে।’ (বোখারি : ১৯৩৪)।
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার এটা পছন্দ নয় যে, মানুষ টাকার জন্য জীবন দিয়ে দেবে। কোনো খদ্দের কিছু ক্রয়ের জন্য এসেছে, আপনি তাকে মূল্য বলেছেন, এই মূল্য পরিশোধ করার মতো ক্ষমতা তার নেই; তবু আপনি তার সঙ্গে নরম আচরণ করুন। আপনার লোকসান না দিয়ে লাভ কিছুটা কমিয়ে দিন। এমন না হয় যে, আপনি কসম খেয়ে বসে গেলেন, আমি এত হলেই দেব, এর কমে নয়, যা কিছু হোক। আপনি যদি দেখেন এই ক্রেতার এ জিনিসটি একান্তই দরকার; কিন্তু তার কাছে প্রয়োজনীয় টাকা নেই, তাহলে তার সঙ্গে নরম আচরণ করুন।
তদ্রƒপ ক্রয়ের সময়ও নম্র আচরণ করা উচিত। বিক্রেতাকে জবরদস্তি করা যাবে না যে, অবশ্যই হ্রাস কর। আপনি কম করাতে চাইলে এক বা দুইবার তাকে বলুন, ভাই! এই মূল্যে দিতে পারলে দিয়ে দিন। সে দিলে তো ঠিক হলো, না দিলেও ঠিক আছে। তার ওপর জবরদস্তি একেবারেই অনুচিত।
দোকানদার থেকে জোর করে মূল্য হ্রাস করে ক্রয় করা : অধুনা জোর করে মূল্য হ্রাস করার প্রচলন দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, ক্রেতা বিক্রেতার মাথার ওপর সওয়ার হয়ে তাকে একেবারে অসহায় ও অক্ষম করে দেয়; অবশেষে সে নিরুপায় হয়ে বলে, ঠিক আছে, এই মুসিবত দূর কর, যদিও কিছু টাকা লোকসান হয়। এমন কথা বলে দোকানদার যদিও আপনাকে মাল দিয়ে দেয়; তবু আমি মনে করি সে জিনিস আপনার জন্য হালাল হবে না। কেননা রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলমানের মাল তার আন্তরিক অনুমতি ব্যতীত গ্রহণ হালাল নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯৭৭৪)।
আর আপনি তো তার কাছ থেকে জোর করে দাম কম করিয়েছেন। তার সন্তুষ্টি ছিল না, তাই এ মাল হালাল হবে না। তাই মূল্য হ্রাস করার জন্য বেশি পীড়াপীড়ি করা এবং বিক্রেতার পেছনে লেগে থাকা মোমিনের মর্যাদার পরিপন্থি।
এসব দ্বীনের কথা এবং নবী করিম (সা.) এর চরিত্র। এগুলো অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। নিজের সাধারণ লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে নম্র আচরণ করুন। আর যদি টাকা থাকে, কাক্সিক্ষত জিনিস নেই, তবে ক্রয় করবেন না। কিন্তু জোরজবরদস্তি করা, ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়া মোমিনের রীতিনীতি ও অভ্যাস নয়।
এর সুন্দর মূলনীতি রাসুল (সা.) বাতলে দিয়েছেন যে, কারও সঙ্গে লেনদেন করার সময় ওই ব্যক্তিকে নিজের আসনে এবং নিজেকে ওই ব্যক্তির আসনে বসাও। আর চিন্তা কর আমি তার স্থানে হলে কী পছন্দ করতাম, তো তুমি যে লেনদেন নিজের জন্য পছন্দ করতে ওই লেনদেনই তার সঙ্গে কর। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নিজের ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ কর, যা নিজের জন্য পছন্দ করতে।’ (বোখারি : ১২)।
এমন যেন না হয় যে, দুটি নিক্তি বানিয়ে নিয়েছে; একটি নিজের জন্য অপরটি অন্যের জন্য। বরং একই নিক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিজের ও অপরের কাজকে পরিমাপ কর।
এটি এমন একটি সোনালি মূলনীতি, মানুষ যদি নিজের জীবনে তা গ্রহণ করে, তবে না জানি কত লড়াই, ঝগড়া-বিবাদ ও বেয়াদবির তুফান বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ লেনদেনের সময় যদি আমি তার স্থানে হতাম, তো আমি যতটুকু পীড়াপীড়ি করছি, যদি সে আমার সঙ্গে এতটুকু পীড়াপীড়ি করত, তবে আমি কি তা পছন্দ করতাম? যদি না করি তাহলে আমারও তার সঙ্গে এরূপ করা উচিত নয়। মুসলমানদের ব্যবসাবাণিজ্য, কারবার ও লেনদেনে যদি অমুসলিমদের থেকে কিছুটাও পার্থক্য থাকে তাহলে বোঝা যাবে এটা মুসলমানের কাজ। এটাও বোঝা যাবে যে, আমি মুসলমানের সঙ্গে লেনদেন করছি।
এসব মূলনীতি অমুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছে : আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে টেলিফোন করে আপনি এক বা  দেড় মিনিট কথা বলেছেন। এরপর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ফোন করে আপনি বললেন, আমি অমুক নাম্বারে ফোন করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু রং-নাম্বারে কল চলে যায়, আমার কাক্সিক্ষত নাম্বারে কল যায়নি। তখন অফিস থেকে বলা হবে, ঠিক আছে, আমরা আপনার টেলিফোন বিল থেকে এই কলের টাকা বাদ দেব।
এখন আমাদের বাংলাদেশি ভাই আমেরিকা পৌঁছে টাইপ রাইটার ক্রয় করে মাসখানেক ব্যবহার করার পর গিয়ে বলে এটি পছন্দ হয়নি। তাই দোকানদার ফেরত নিয়ে নেয়। শুরুতে তারা ফেরত নিত; কিন্তু দেখা গেল লোকজন এই কারবারই শুরু করে দিয়েছে। তাই ফেরত নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।   
অমুসলিমরা ব্যবসাবাণিজ্য ও লেনদেনের এসব মূলনীতি, আদব ও নিয়মকানুন ইসলাম ও পূর্বসূরি মুসলমানদের থেকে গ্রহণ করেছে। তাই আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায়ে উন্নতি দান করেছেন, শিল্পকে বিকশিত করেছেন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রগতি দিয়েছেন।
ব্রিটেনে বেকারভাতা দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি বেকার বা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সরকার জানতে পারলে তার জন্য ভাতা জারি করে দেবে। এর অর্থ, সে যতক্ষণ বেকার থাকবে, ততক্ষণ না খেয়ে মারা যাবে না। তার কর্মক্ষমতা থাকলে সে কর্ম খুঁজতে থাকবে, চেষ্টা চালিয়ে যাবে। রোজগারের ব্যবস্থা হলে নিজেই নিজের খোরাকের ব্যবস্থা করবে। পক্ষান্তরে সে অক্ষম হলে ভাতা পেতেই থাকবে।
এখন আমাদের মুসলমান ভাইদের বড় একটি অংশ সেখানে বসবাস করে। তারা নিজেদের বেকার প্রকাশ করে ভাতা চালু করে রেখেছে। অনেকে বলে, আরামে ঘরে বসেই যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে, তবে কামাই করার কী প্রয়োজন? আর কতক এমন আছে, যারা গোপনে কামাইও করছে আবার বেকারভাতাও নিচ্ছে। আমরা এই আজাবে নিপতিত; তাহলে রহমতবর্ষণ হবে কীভাবে? আর আমাদের অবস্থা যখন এই দাঁড়িয়েছে তবে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য কীরূপে আমাদের সঙ্গী হবে? 
সমাজব্যবস্থার সংশোধন নাগরিকদের দ্বারাই হয় : কোনো সমাজের সংশোধন নাগরিক ও জনগণের দ্বারাই হয়ে থাকে। সবাই করছে তাহলে আমি একা এর বিপরীত করে কী করবÑ এটা মনে করা শয়তানের ধোঁকা। অন্যরা যা ইচ্ছা তা-ই করুক, আমার তো সে দিকে ভ্রƒক্ষেপের কোনো দরকার নেই। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘পথভ্রষ্ট লোকরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি তোমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়ে থাক।’ (সূরা মায়েদা : ১০৫)।
নিজের দিক বিবেচনা করে নিজের লেনদেন আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে ঠিক করে নেওয়াই আমাদের কর্তব্য। আর রাসুল (সা.) যে আখলাক ও চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন তার অনুসরণ করা একান্ত আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালার নীতি এই যে, যখন একটি বাতি জ্বলে ওঠে, তখন এই বাতি থেকে আরও বাতি জ্বলে ওঠে এবং জ্বলতেই থাকে।

Post a Comment

0 Comments