১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণে মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। ওসমানী সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৬ ডিসেম্বর ওসমানীকে সেনাবাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদা (অক্রিয়) প্রদান করা হয়।
১৯৭১ সালে কে এম (কাজী মুহাম্মদ) সফিউল্লাহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানী কেন উপস্থিত ছিলেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘‘১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম ঢাকার ডেমরা এলাকায়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল অরোরা। যদিও থাকার কথা ছিল ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশের। ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি। তবে জেনারেল ওসমানী আগে কোনও এক সময় বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনাপ্রধান যদি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে বাংলাদেশের উপসেনা প্রধান থাকবেন।’ কারণ, এটা প্রটোকলের প্রশ্ন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে একে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম। তারা যখন আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন, তখন আমি টেবিলের সামনে দাঁড়ানো ছিলাম।’’
কে এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘এছাড়া, সেদিন জেনারেল ওসমানী সিলেট সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলেন। তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার শক্রুপক্ষের গুলিতে বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রব সাহেব গুলিবিদ্ধ হন।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদরদফতরে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরবর্তীতে ‘একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। অনুপম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন এমএজি ওসমানী ছিলেন না, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বইটির ২৪১ পৃষ্ঠায় নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্ব শেষ হওয়ার দুদিন পর জেনারেল ওসমানী বিক্ষুব্ধ-উত্তপ্ত মুজিবনগর সরকারের সদর দফতরে ফিরে আসেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষোভ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টির হয়, যা মুজিবনগর সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুজিবনগরে জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা সরকারের নেতারাও তার ওপরে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতরে পা রেখে জেনারেল ওসমানী উত্তাপ কিছুটা টের পেয়েছিলেন।’
‘... জেনারেল ওসমানীর এডিসি সবিস্তারে জেনারেল সাহেবের অনুপস্থিতিতে তাকে ঘিরে কে কী মন্তব্য করেছেন, সব কথা তাকে রিপোর্ট করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অবহিত হওয়ার জন্য জেনারেল সাহেব আমাকে তার কক্ষে ডাকেন। খুব ধীরস্থির হয়ে বসে জেনারেল ওসমানীকে জানালাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনার অনুপস্থিতি নিয়ে এখানে রাজনৈতিক মহলে বিরূপ সমালোচনা হয়েছে।’
নজরুল ইসলাম আরও লিখেছেন, ‘জেনারেল ওসমানী কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনও চেতনা এখনও জন্ম হয়নি।আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনও সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে, আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।’
জেনারেল ওসমানী বলেন, ‘নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল শ্যাম মানেকশ। সত্যি কথা আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনও দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে আমার যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশের সমান। সেখানে জেনারেল মানেকশের অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়, এটা প্রটোকলের ব্যাপার।
ওসমানী বলেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব। ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশের পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীনে ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই?’
বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী ওসমানী তখন নজরুল ইসলামকে বলেন, ‘আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশের পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। সেখানে আমার ভূমিকা কী? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করা হচ্ছে।’
জেনারেল ওসমানী বলেন, ‘প্রটোকল সম্পর্কে আমাদের লোকদের কোনও ধারণা নেই, তাই এত ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি। লোকজনকে বুঝিয়ে বলুন।’
একইসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে কেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সে বিষয়টিও উঠে এসেছে এই বইটিতে। বইয়ের ২৪৪ পৃষ্ঠায় লেখক নজরুল ইসলাম জানান, ‘জেনারেল ওসমানীকে জানিয়েছিলাম যে, পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে কেন আত্মসমর্পণ করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী জেনারেল সাহেবের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। দেওয়ান গাজী আমার (নজরুল ইসলাম) কথা শুনতে পেয়ে বললেন, পিআরও (নজরুল ইসলাম) সাহেব ঠিকই কইছুন। মানুষ চায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করুক।’
জেনারেল ওসমানী দেওয়ান গাজীর ওপর তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, ‘তোমরা লোকজনকে অন্ধকারে রেখেছো। দুনিয়ার রীতিনীতি সম্পর্কে মানুষকে কিছু জানতে দাও।’ ওসমানী বলেন, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, আত্মসমর্পণ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে। জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, আত্মসমর্পণ ইত্যাদির ব্যাপারে এ নীতিমালা মানতে বাধ্য। আমরা মানে বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নই। এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হবে না। কারণ, তাদের (পাক বাহিনী) ধারণা, আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমরা তাদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনে বর্নিত নীতিমালা অনুযায়ী আচরণ করবো না। যেহেতু আমরা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় পড়ি না, তাই জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালা মানতে আমরা বাধ্যও নই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী পরাজিত আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের হত্যা করা বা কোনও রূপ নির্যাতন করা যায় না। তাদের নিরাপত্তায় আইনি প্রটেকশন দিতে হয়। সামরিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়। উন্নত খাবার, নানান সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। বন্দিকালীন সময়ে নিরস্ত্র অবস্থায় এক্সারসাইজ, খেলাধুলা ইত্যাদির সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু আমরা তো এখনও ভারতের মাটিতেই রয়ে গেছি। বাংলাদেশই তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনও নিয়মিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী নেই। এমনকি পুলিশ বাহিনীও নেই। এ অবস্থায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমরা তাদের রাখবো কোথায়? তাদের প্রটেকশন দেবো কিভাবে? ৯০ হাজার সৈন্যকে তিন বেলা উন্নত খাবার দেবো কোথা থেকে। দেশে গিয়ে তো আমরাই খাবার পাবো না।’
0 Comments