হাসান আজিজুল হক: প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ জানাচ্ছেন, রাষ্ট্র যখন তার সকল নাগরিককে
শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তখন সে রাষ্ট্র আর কী করছে তাতে কিছুই
যায়-আসে না। শিক্ষাহীন নাগরিক তাঁর মতে, সর্বার্থে অদক্ষ। তাকে দিয়ে
রাষ্ট্রের কোনো কাজ হবে না ঠিক যেমন যে ঘোড়াকে আরোহী পিঠে নিতে অভ্যস্ত করা
হয়নি সে ঘোড়াকে দিয়ে কারো কোনো প্রয়োজন মেটে না। প্লেটো রাষ্ট্র পরিচালিত
নির্দিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা নারী পুরুষ সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করতে বলেন।
তাতে রাষ্ট্র একমুখী গতি পায়।
বাংলাদেশে যে সামান্য
উচ্চশিক্ষিত মানবশক্তির সৃষ্টি হচ্ছে, যতদূর খবর পাই তার প্রয়োগক্ষেত্র
একেবারেই অপরিসর। যেটুকু বা ব্যবহার তাও একরকম অনুত্পাদনশীল—সেজন্যই
বাংলাদেশে উত্পাদন নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেরই প্রাধান্য। শিক্ষিত বেকার
প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তাদের ধারণ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। সেটা যদি না থাকে
তা হলে আস্তে আস্তে প্রাথমিক পর্যায়েও ঢিলা পড়বে। কিছু পরিসংখ্যান দেখিয়েই
খালাস। শিক্ষিতদের মধ্যে যারা কাজ পেয়েছে, তারা প্রায় সবাই বেমক্কা কাজ
করে। দর্শন পড়ে এসে ব্যাংকে কেরানি হয়, বিজ্ঞান পড়ে হয় এনজিওর কর্মী। পাস
করেই রাজধানীর দিকে—নিম্নপক্ষে শহরগুলোর দিকে ছোটে—কী পাই, কী পাই—কলেজে
স্কুলে কোনোরকমে দু-চার লাখ টাকা ‘ডোনেশন’ দিয়ে চাকরি পেলে হাতে স্বর্গ
পাওয়া গেছে ভাবতে হয়। এখন ছানাপোনা নিয়ে সংসার করতে পারবে। সারাজীবন
কেমনভাবে কাটাতে পারবে তা নিয়ে তার তখন স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের অন্ত নেই।
ভাগ্যিস মিডিয়াগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করছে—খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল, বিজ্ঞাপন
সংস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। সেখানে জুটে যেতে পারলে ভালো। এনজিও কত যে আছে
তার হিসাব নেই—তাদের সরল লক্ষ্যে জিলাপির প্যাঁচ। বাইরের টাকা যা আসছে, তার
বেশি যাচ্ছে। দেশ চালাতে গিয়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসক নিশ্চিন্তবোধ করছে:
যাক কিছু চাপ তো কমছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক এনজিও পালন করে দিচ্ছে:
প্রাইমারি শিক্ষার অনেক দায়িত্ব তারা নিয়েছে। এখন উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা
একটা ব্যবস্থাই গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। চিকিত্সা ব্যবসার
জন্য বহু প্রথম শ্রেণির হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। ব্যাংক ব্যবসাতে তাদেরই
প্রাধান্য। শিক্ষা ব্যবস্থাতেও তারা নাক গলায় নির্দ্বিধায়। একরকম স্বাধীন
ক্রীতদাসত্ব স্বীকারোক্তিতে হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ মানুষেরা। এদের জন্য
যোগ্য কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। বাংলাদেশের যে বিপুল
সম্পদ তার সঙ্গে ষোলো কোটি মানুষের মানবসম্পদ যখন বজায় আছে তখন বাংলাদেশের
এরকম দশা কেন—এই প্রশ্নের উত্তর দাবি করার ক্ষমতা এ দেশের মূক সাধারণ
মানুষের নেই।
সংক্ষেপে আমার কথা দাঁড়াল এই : ভূখণ্ডের
তুলনায় স্থান সংকুলান অসম্ভব মনে হলেও অতি জনবসতিসংকুল এই বাংলাদেশে
লোকসংখ্যা ষোলো কোটি ছাড়িয়েছে। এত বিশাল মানবসম্পদের ব্যবহার করার কাঠামো
রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেনি। সেজন্য দক্ষ শ্রমের সৃষ্টিতে ব্যর্থ রাষ্ট্র
যেটুকু বা দক্ষ শ্রম সৃষ্টি করতে পারে, তারও পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না।
উন্নত বিশ্বের ওপর নির্ভরতা-অর্থে ও পণ্যে-দাসত্বের পর্যায়ে চলে গেলেও তা
বন্ধ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। এ কারণে এ দেশের অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে
সংস্কৃতিতে সর্বক্ষেত্রে মেরুদণ্ড সিধে রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকে না।
আমরা বাংলাদেশের তৈরি সামান্য কিছু পণ্যও পাই না। পেলেও রাষ্ট্রের তরফ থেকে
উত্সাহ জোটে না। এখন বড় বড় দেশের কথা দূরে থাক—চীন জাপান ভারত কোরিয়া
মালয়েশিয়া থেকে সূঁচটাও চলে আসে। একটা ভালো বিস্কুট কিনতে গেলেও মালয়েশিয়া
বা কোরিয়ার জিনিস কিনতে চাইছে লোকে। শপিংমলের কালচারটা আপনা-আপনি তৈরি
হয়নি। মুদিখানার দোকান-টোকানও এখন উঠে গিয়েছে, যা আছে সেখানেও ঐ বিদেশি
পণ্য। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আমাদের একমাত্র ভূমিকা হচ্ছে ক্রেতার
জন্য—বিক্রেতার নয়। মুক্ত বাজার মোটেই মুক্ত নয় আমাদের। বড় বড় দেশ
প্রতিনিয়তই আমাদের লেজে খেলাচ্ছে। এটা তোমাদের বেচব না, এটার জন্য অবরোধ
আছে। তোমাদের দেশের যা কিছু আছে সে খনিজ সম্পদই হোক বা বাণিজ্য লেনদেনই হোক
সব জায়গাতেই তোমরা অধমর্ণ—রপ্তানি করার জন্য তোমাদের যা কিছু আছে দু-চার
ডলারের বিনিময়ে সেসব আমাদের দিয়ে দাও। কয়লা আছে, তেল আছে, সমুদ্রে তোমাদের
যে ভূখণ্ড জেগে উঠছে, গভীর সমুদ্রে কত তেল তোমাদের আছে—এসব কোনো কিছুই
উত্তোলন করে বা সংগ্রহ করে বাণিজ্য করতে পারবে না, করার ক্ষমতা তোমাদের
নেই—৩-৪% নিয়ে আমাদের বাকিটা দিয়ে দাও। ইলিশ আমাদের হয় না—তোমরা আবার খাবে
কি, রপ্তানি করে দাও।
গ্লানিতে মন পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
দেশপ্রেম যেখানে যাবার সেখানেই গিয়েছে। দেশপ্রেম নিয়ে কি ধুয়ে খাওয়া হবে।
গানে বাজনায় বাক্যে বক্তৃতাতে দেশপ্রেম থাকলেই যথেষ্ট। জাতীয় সঙ্গীত ঠিকই
আছে, ফর্দাফাঁই হয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে প্রকৃতি। সুন্দরবনের বাঘেরা হালুম বলছে
না গেলুম বলছে বোঝা দায়।
একটা উপায় ছিল বটে—দক্ষ শিক্ষিত
জনশক্তি অনেক অধ্যবসায় সৃষ্টি করা এবং তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো বিশাল
জনসংখ্যার তুলনায় যে অতি ক্ষুদ্র সংখ্যক দক্ষ, শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত জনশক্তি
অন্তত সেটা পরিপূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করা। শিক্ষায় ফাঁক থাকার জন্য যে অতি
স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ দেশে আছে তার কর্মশক্তির বেশিটাই ব্যয় হয়েছে
প্রযুক্তি: যা বর্তমানে লভ্য হয়েছে তা চালু রাখা। নতুন উদ্ভাবন,
ব্যবহারযোগ্য, কর্মলগ্ন করার কাজ হচ্ছে কই। দেশের বড় বড় বিজ্ঞানাগারে গরু
চরে, বনজঙ্গল বাড়ে, জমি নষ্ট হয়; ঢাকায় সেন্টার ফর এক্সেলেন্সের একজন
কর্তাব্যক্তি আমাকে একদিন বিজ্ঞানাগারের তালা খুলে দেখিয়েছিলেন। তালা বন্ধ
হয়েই থাকে। তিনি চাবি আনিয়ে ল্যাবরেটরি দেখালেন। এই মুহূর্তের বিশ্বের
বিজ্ঞানের আধুনিকতম যন্ত্রপাতি সব ঘুরে ঘুরে দেখালেন। কিছুই ব্যবহার হয় না।
দেশি বিদেশি গবেষকদের জন্য চমত্কার থাকার জায়গা নির্মাণ করে রাখা হযেছে।
বছরের পর বছর বন্ধ পড়ে থাকে—কেউ আসে না। দেশের মাথার মণি প্রতিভাবান
প্রশিক্ষিত অতি দক্ষ মানুষেরা সাধারণত ভাড়া খাটতে বিদেশে চলে যান। অনেক
কৃতিত্ব অর্জন করেন। তাঁদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবুক। দেশের জনসংখ্যার তুলনায়
অপ্রতুল যত্সংখ্যক শিক্ষিত দক্ষ সমাজ সদস্যদের কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না!
কোথায় কিসের বাধা? দেশের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো (পাবলিক প্রাইভেট মিলিয়ে)
থেকে যারা বেরিয়ে আসছেন তাঁদের ব্যবহার করা যাচ্ছে না কিংবা নিতান্ত মাটো
সাধারণ কাজ ছাড়া আর কিছু দেয়া যাচ্ছে না—সে কি আমাদের সম্পদের অভাবে? এরা
নিজেরাই কি সম্পদ নয়? কিংবা সত্যিই যোগ্য দক্ষ কর্মী নাগরিক সৃষ্টিই হচ্ছে
না। আমার মনে হয় না সম্পদের অভাবে এই অবস্থা। এটা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট
হয়। এত পিছিয়ে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ! এই যদি হয় অবস্থা
তা হলে প্রাইমারি পর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আস্তে আস্তে যারা ঝরে
পড়েছিল তাদের হিসাব নেয়া এখন আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে। এদের নিয়ে কেউ
ব্যস্ত নয়। যথাস্থানে—মানে সাধারণ জনগণের কাছে, তাদের বাবা-মায়ের কাছে
তারা ফিরে গেলে কিন্তু পিতৃস্নেহ মাতৃস্নেহতেই কাজ হবে না—বিষ ছড়িয়ে পড়বে
সমাজেই। সরকার এই অদক্ষ শ্রমের ভার পিঠ কুঁজো করে সইবার বদলে তাদের বিদেশে
শ্রমিক, গৃহ-পরিচারিকা ইত্যাদি কাজে বাইরে পাঠিয়ে দিক। তারা বাবা মায়ের যা
কিছু আছে সব বিক্রি করে দিয়ে বাইরে চলে যাক। সরকারকে জানিয়ে বা না জানিয়ে।
তারা জেলে পচে মরুক, এক দেশ থেকে আর এক দেশে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে
মরুক—কারো শিরশ্ছেদ হোক, ফাঁসি হোক—শত হলেও বৈদেশিক মুদ্রা তো দেশে আসছে।
দেশ চলছে এই টাকায়। এতে বিদেশে গায়ে গতরে খাটতে, মাথা ও মস্তিষ্ক বেচতে
যারা যেতে পারে তাদের নিজেদের গর্ব যেমন বাড়ে, দেশের গর্বও তেমনি বাড়ে।
রবীন্দ্রনাথ হয়তো বলতেন, কোলে জায়গা দিতে পারলি না মা? কেন? অদক্ষ শ্রম
বাইরে পাঠিয়ে তো ভালো ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
শুধুমাত্র
নিন্দা-মন্দ করার জন্য এই লেখা নয়। বিশাল সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা মার
খেয়েছে তার জন্যই রাষ্ট্র ও সমাজকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এক
গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির দম হারিয়ে ফেলা বা কতকগুলো আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে
নিজের এবং অন্যদের সন্তুষ্টি ঘোষণা করা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। তাতে
হয়তো নিজের চামড়া বাঁচে, দায় চুকে যায়, কিন্তু তাতে করে সমাজ ও রাষ্ট্রের
অধোগতি রোধ করা যায় না। বরং তাতে নিষ্ক্রিয়তাকেই উস্কে দেয়া হয়। এর চেয়ে
ভুল সমালোচনা করা ভালো। আমার এই লেখাটিতে ভুল বিচার হয়তো অনেকটাই আছে—সেটা
অন্যেরা আমাকে জানাবেন, চুপ করে থাকবেন না এই অবস্থান থেকেই বিষয়টাকে তুলে
ধরার চেষ্টা করা গেল। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তো দৃঢ়বদ্ধ বিধায়ক সমাজ
নির্মাণের চেষ্টা করা। সেটা সাফল্য ও বিফলতা ধরেই এগোয়। গোঁজামিল দিয়ে
শুধুমাত্র সাফল্য তুলে ধরাই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। উটপাখির মতো
বালিতে মুখ গুঁজে বিরাট বিরাট ত্রুটি ও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত
বিফলতাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং বুক বেঁধে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই সংকল্প
করা আসল কথা। রোগ না বুঝলে প্রতিকার নিরাময় সম্ভব নয়। আসল কথা রাষ্ট্র কী
কেন কার এসব প্রশ্ন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ—সেটা ঠিক করতে পারলেই অর্থপূর্ণ
কথা বলা যায়। আর বিদ্বেষপূর্ণ দোষারোপের সংকীর্ণতাও এড়ানো যায়। আমি খুব
সংক্ষেপে তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।
n লেখক:কথাসাহিত্যিক
0 Comments