অভাজনের ভ্যারেন্ডা ভাজন

অ্যাডভেঞ্চার! শব্দটা পড়ামাত্র কি আপনার রক্ত-চলাচল দ্রুততর হয়ে উঠেছে?

আপনি কি এমন কোনো জায়গার কথা ভাবছেন, যার সম্বন্ধে অনেক কিছু লেখা হয়েছে কয়েকশো বছর ধরে, যার সন্ধানে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছেন অনেক অভিযাত্রী... কিন্তু, আজও যা রয়ে গেছে তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর নাগালের বাইরে?
“চাঁদের পাহাড়”, “হিরেমানিক জ্বলে”, “পাহাড় চূড়ায় আতংক”-র চেয়ে বেশি কিছু পড়ার একটা হালকা ইচ্ছে কি শীতের রোদের মতো আপনার পিঠ, কান হয়ে মাথায় পৌঁছতে চাইছে?
১৮৭১ সাল। ওয়েলশ সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলি ফিরে এলেন আফ্রিকার গহনতম অরণ্য থেকে। নীল নদের উৎস খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্কটিশ মিশনারি ডেভিড লিভিংস্টোন-কে খুঁজে বের করেছেন তিনি! সেই বৃত্তান্তই প্রকাশিত হল খবরের কাগজে।
‘ডার্ক কন্টিনেন্ট’ নামে পরিচিত আফ্রিকার অন্দরমহলের সবুজ অন্ধকারের একটা স্পষ্ট ছবিও ফুটে উঠতে থাকল বাইরের পৃথিবীর চোখে।
নীল নদের পশ্চিম তীরে, থেবেস-এর উলটোদিকে অবস্থিত ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’ খনন করে তখন নতুন করে লেখা হচ্ছে ইতিহাসের অনেক কথা।
মধ্য আমেরিকার জঙ্গলের বুক থেকে মাথা তুলছে মায়া সভ্যতার বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থাপত্য।
এমনকি, হোমারের বর্ণনায় পড়া যে ট্রয় তখনও স্রেফ কিংবদন্তির বিষয় হয়ে ছিল, তাকেও ততদিনে খুঁজে পাওয়া গেছে আনাতোলিয়ার বিগা উপদ্বীপে!
এক রোমান্টিক তরুণ, যে জুলু যুদ্ধ ও বোয়র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া গ্রেট জিম্বাবোয়ে সভ্যতার ভাঙাচোরা অবশেষ নিজের চোখে দেখেছে, তার ওপর এসবের কেমন প্রভাব পড়তে পারে?
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের মাথায় সাহিত্যের পোকাটা কামড় বসিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত রবার্ট লুই স্টিভেনসন-এর লেখা সুপারহিট উপন্যাস ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’-এর চেয়েও ভালো লেখা লিখতে পারবেন, এই মর্মে ভাইয়ের সঙ্গে পাঁচ শিলিং-এর বাজি ধরে ফেলেন তিনি। সেই খুচরো পাপের বশে, স্কটিশ অভিযাত্রী জেমস থমসন-এর জনপ্রিয় বই ‘থ্রু মাসাই ল্যান্ড’ থেকে তথ্য নিয়ে, বিখ্যাত ব্রিটিশ হোয়াইট হান্টার ফ্রেডরিক হেনরি সেলাস-এর আদলে কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যালান কোয়াটারমেইন-কে গড়ে, হ্যাগার্ড একটা রোমহর্ষক উপন্যাস লিখলেন
সেপ্টেম্বর ১৮৮৫-তে ‘দ্য মোস্ট অ্যামেজিং বুক এভার রিটেন’ তকমা গায়ে এঁটে যে বইটি আত্মপ্রকাশ করল, সেটি ইতিহাস তৈরি করে

বইটি ছিল “কিং সলোমন’স মাইনস”।


“কিং সলোমন’স মাইনস” এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রকাশক বইটা ছেপে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। শুধু জনপ্রিয়ই নয়, সাহিত্যে একটি আস্ত জঁর তৈরি হয় এই বইয়ের সৌজন্যে, যাকে হারানো জাতি/সভ্যতা-র সন্ধান নামে চিহ্নিত করা যায়।
একটা মানচিত্র সম্বল করে, কয়েকজন বন্ধু ও এক পোড়খাওয়া অভিযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা, পদে-পদে আসা বিপদের সঙ্গে সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে বোঝাপড়া করা, অব্যাখ্যাত রহস্যের সম্মুখীন হওয়া, বিশ্বাসঘাতকতা, ট্র্যাজেডি দিয়ে সাজানো “কিং সলোমন’স মাইনস” বইয়ের পাতায় নাক-গোঁজা পাঠকদের পাশাপাশি আরো অনেককেই যে প্রভাবিত করেছিল, একথা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে, অজানার আহ্বানে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে সত্যিই ইতিহাস গড়ে দেন যে মানুষটি তাঁর নাম: লেফটেন্যান্ট কর্নেল পার্সিভ্যাল হ্যারিসন ফসেট

১৮৮৬ সালে রয়্যাল আর্টিলারি-তে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন ফসেট। ১৯০১ সালে তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি-র সদস্য হন অভিযান চালানো আর ম্যাপ বানানোর কৌশল আয়ত্ত করতে।
কেন?
যাতে, সার্ভেয়ার-এর ছদ্মবেশে উত্তর আফ্রিকায় ঘোরাঘুরি করে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস-এর হয়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় তাঁর নকল চেহারাটা যেন ধরা না পড়ে!
অভিযাত্রী হিসেবে ফসেটের দক্ষতা রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে ১৯০৬ সালে ব্রাজিল-বলিভিয়া সীমান্তে একটি দুর্গম জঙ্গুলে জায়গার ম্যাপ বানানোর জন্য তাঁকেই পাঠানো হয়। মাত্র ৩৯ বছর বয়সী ফসেট সেই অভিযান চলাকালীন শুধু ম্যাপ-ই বানাননি, সঙ্গে দেখেছিলেন অনেক তখনও অবধি অজানা পশু-পাখি, এবং মেরেছিলেন একটি ৬২ ফুট লম্বা অ্যানাকন্ডা!


সাহস, ধৈর্য, স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে ভদ্র ও সম্মানজনক ব্যবহার, এবং মনের জোর সম্বল করে ১৯০৬ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে ফসেট দক্ষিণ আমেরিকায় মোট সাতটি অভিযান চালান, যাদের বিবরণ ঠাঁই পেয়েছিল ‘এক্সপ্লোরেশন ফসেট’ বইয়ে। রিও ভার্দে এবং হিথ নদীর উৎসও খুঁজে বের করেছিলেন ফসেট
আমাজন অববাহিকা থেকে পাঠানো তাঁর নানা ডিসপ্যাচ তথা রিপোর্টের ভিত্তিতে, এবং তাঁর অনমনীয় স্বভাবের ছায়ায় এক চরিত্র গড়ে সেই সময়ে দুনিয়ার জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন তাঁর অন্য এক সৃষ্টির নামমাহাত্ম্যের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কিছু লেখার সুযোগ পান।


হ্যারি রুনট্রি’র অলঙ্করণে সমৃদ্ধ হয়ে, ১৯১২-র এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস জুড়ে ‘স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন’-এ ধারাবাহিক ভাবে, ও তারপর বই হয়ে বেরোয় স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অদ্বিতীয় উপন্যাস “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড”। ফসেটের আদলে ডয়েল জন্ম দেন প্রফেসর জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার-এর। মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে, প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জার, লর্ড রক্সটন, সাংবাদিক ম্যালোন-এর সাক্ষাতের সেই রোমহর্ষক কাহিনি পড়েননি, এমন কেউ কি আছেন?



কিন্তু, অজানা জগতের মানচিত্র গড়া, তথা সেইসব জায়গা ও তার মানুষদের লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে সভ্য দুনিয়ায় খ্যাতি ও শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া সত্বেও, ফসেটের অদম্য মানসিকতা তাঁকে নিশ্চেষ্ট হয়ে ঘরবন্দি হতে দেয়নি।
তাছাড়া, বিশ্ব জুড়ে বেজে ওঠা যুদ্ধের দামামা, হত্যালীলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা এপিডেমিকে এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর মধ্যেও অতীতের পাতা উলটিয়ে অজানা সভ্যতা মানুষের চোখের সামনে আসাও তো থেমে থাকেনি।
২৪শে জুলাই ১৯১১ মার্কিন ঐতিহাসিক হিরাম বিংহ্যাম পেরু-র মাচুপিচু অঞ্চলে পাহাড়ের ওপরে, ষোড়শ শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হওয়া, ইনকাদের অতুলনীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সাক্ষ্য দেওয়া এক দুর্গশহর বা সিটাডেল খুঁজে পান। সভ্য পৃথিবীর নজর তৎক্ষণাৎ আমাজনের অন্ধকার জঙ্গল থেকে সরে আসে আন্দিজের ওই পাহাড়চুড়োয়।
১৯১৯-২০-তে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র ওয়েস্টার্ন ডিভিশনের সুপারিন্টেন্ডিং আর্কিওলজিস্ট রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু নদের কাছে, লারকানা জেলায় মোহেঞ্জোদারো নামের জায়গাটায় খুঁজে পান এমন একটা ধ্বংসস্তূপ, যা এক ঝটকায় উপমহাদেশের ইতিহাসকে পিছিয়ে দেয় কয়েক হাজার বছর।
ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এর ‘কেভি ৬২’ নামে চিহ্নিত জায়গাটিতে লর্ড কারনাভন-এর উদ্যোগে, হাওয়ার্ড কার্টার-এর নেতৃত্বে চালানো খননের ফলে ৪ঠা নভেম্বর ১৯২২ যে সিঁড়ির ধাপগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, তারাই সভ্য পৃথিবীকে নিয়ে যায় অতুল সম্পদ আর অজস্র রহস্য, এমনকি অভিশাপে ঘেরা তুতানখামেনের মমির কাছে!
সোনা আর রহস্যের ওই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় সব্বার। বিশেষত, আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের সেইসব মানুষেরা, যাঁরা ফসেটের ডিসপ্যাচের ভিত্তিতে বহু-বহু বছর ধরে গুজব আর কিংবদন্তি হয়ে থাকা একটা জায়গাকে শেষ অবধি খুঁজে পাওয়ার রাস্তা দেখতে পেয়েও এতদিন তাকে ঠিক গুরুত্ব দেননি, এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়েন।
কী বলেছিলেন ফসেট?


ব্রাজিলের মাতো গ্রসো এলাকায়, এবং আমাজন অববাহিকায় অভিযান চালানোর সময় স্থানীয় একাধিক উপজাতির মুখে ফসেট অরণ্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি শহরের কথা শুনেছিলেন। শহরটিকে তিনি ‘লস্ট সিটি অফ জেড (Z)’ নাম দেন।
ইতিমধ্যে, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ব্রাজিল-এ ফসেট একটি ডকুমেন্ট (ম্যানুস্ক্রিপ্ট ৫১২-পার্ট)-ও পেয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী জোয়াও ডা সিলিভা গিমারেজ-এর লেখা ওই ডকুমেন্টে ছিল বাহিয়া প্রদেশে ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ডা সিলভা’র নিজের চোখে দেখা এক পরিত্যক্ত শহর, বিভিন্ন মূর্তি, চিত্রলিপিতে ঠাসা একটা ভাঙা মন্দির, ইত্যাদির বর্ণনা।
ফসেটের ডিসপ্যাচে নথিভুক্ত এই কথাগুলো তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর হঠাৎই ১৫৩৭ সালে স্পেনের কনকুইস্তাদরদের শোনা ‘এল ডোরাডো’-র গল্পকে নতুন চেকনাই দেয়।
সেই গল্পে প্রথমে ছিল স্থানীয় এক উপজাতির প্রধানের কথা, যিনি বিশেষ তিথিতে সর্বাঙ্গে সোনার গুঁড়ো মেখে এক বিশেষ হ্রদের জলে স্নান করতেন। ক্রমে সেই গল্পটা পল্লবিত হতে-হতে হয়ে যায় এমন এক শহরের আখ্যান, যেখানে সবকিছু সোনা দিয়ে তৈরি।
ফসেটের কাঠখোট্টা ডিসপ্যাচ হঠাৎ করে সেই শহরের অস্তিত্বকে বাস্তব করে তোলার ইঙ্গিত দেয়, যার সন্ধান চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন অজস্র অভিযাত্রী, যার খোঁজে বেরিয়ে অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে আস্ত এক-একটা বাহিনী।
১৯২৫ সালে লন্ডনের একঝাঁক সম্পন্ন মানুষের আর্থিক সাহায্য নিয়ে ফসেট ‘জেড’-এর সন্ধানে একটি সুপরিকল্পিত অভিযান চালান। তাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর ছেলে ও ছেলের বন্ধু। বিশ্বাসী, অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু, এবং সক্ষম দুই সঙ্গীকে নিয়ে ফসেট আমাজনের দক্ষিণপূর্ব দিকের একটি উপনদী, আপার জিঙ্গু, পার হওয়ার সময় ‘ডেড হর্স ক্যাম্প’ নামের একটি শিবির থেকে ২৯শে মে, ১৯২৫, তাঁর স্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন। তাতে তিনি রীতিমতো আশাবাদী ছিলেন যে তাঁরা সঠিক পথেই এগোচ্ছেন।


কিন্তু এরপর ফসেট, বা তাঁর দুই সঙ্গীর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি তো বটেই, আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এরপর দশকের-পর-দশক ফসেটের কথিত ‘সিটি অফ জেড’ তথা ফসেটের সন্ধানে বেরিয়ে ব্যর্থ হন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এবং তারপরের ঠাণ্ডা লড়াই তথা পারমাণবিক মহাসমরের সম্ভাবনা, হারানো শহর বা সভ্যতার সন্ধানকে পেছনের সারিতে ঠেলে দেয়। সাহিত্যের আঙিনাতে রোমহর্ষক কাণ্ডকারখানা যা কিছু এরপর হতে থাকে তার বেশিরভাগই গুপ্তচরবৃত্তি বা মার্কিন-সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে লড়াই নিয়েই।
অবশেষে, ১৯৮০ সালে, বিখ্যাত সাহিত্যিক মাইকেল ক্রিকটন পাঠকদের উপহার দেন একটি উপন্যাস, যা ঘোষিতভাবেই ছিল ‘কিং সলোমন’স মাইনস’-এ কথিত রাজা সলোমনের হিরের খনির সন্ধান তথা হারানো শহর/জাতি নিয়ে লেখা। দারুণভাবে সমকালীন এবং তথ্য-তত্ত্ব-উত্তেজনায় ঠাসা এই উপন্যাসটি ছিল: “কংগো”


রত্ন হিসেবে মূল্য না থাকলেও সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে ইলেকট্রনিক্স-এর জগতে বিপ্লব আনা টাইপ টু-বি ডায়মন্ড খুঁজতে গিয়ে কংগোর ভিরুঙ্গা এলাকায় ক্যাম্প করা একদল বৈজ্ঞানিক ও অভিযাত্রীর একটা দল একদল ধূসররঙা গোরিলার হাতে আক্রান্ত হয়এবার শুরু হয় বিভিন্ন দেশের একটি কনসর্টিয়াম এবং ই.আর.টি.এস-এর আরেকটি দলের মধ্যে, ওই জায়গায় পৌঁছে ওই বিশেষ ধরনের হিরের খনির ওপর নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করার জন্য, দৌড়। দুর্ঘটনা, অন্তর্ঘাত, ওই এলাকার দেশগুলোতে চলা গৃহযুদ্ধ ও সামরিক অভ্যুত্থান, এবং আরো নানা বিপদ সামলে বৈজ্ঞানিক কারেন রস-এর নেতৃত্বে, স্থানীয় এক অভিজ্ঞ ভাড়াটে সৈন্য চার্লস মুনরো, একটি বুদ্ধিমান ও সাইন-ল্যাংগুয়েজে পারঙ্গম গোরিলা অ্যামি, এবং তার ট্রেইনার পিটার ইলিয়ট-কে নিয়ে ই.আর.টি.এস-এর দলটি ওই এলাকায় শেষ অবধি পৌঁছে বুঝতে পারে, হিরের খনিকে ঘিরে গড়ে ওঠা কিংবদন্তির হারানো শহর ‘লস্ট সিটি অফ জিনজ (ZINJ)’ খুঁজে পেয়েছে তারা, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সম্পদের পাশাপাশি অনেক রহস্য, আর বিপদ!

তারপর কী হল তা জানতে হলে বইটা পড়তে, বা বইটার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া কিঞ্চিৎ কমজোরি সিনেমাটা দেখতে, অবিলম্বে তৎপর হউন!
সলোমনের খনি আর ফসেটের জেড-কে মিশিয়ে দেওয়া এই দুরন্ত উপন্যাস লিখে ক্রিকটন পাঠকের মনে আবার হারানো জাতি/শহর নিয়ে বিপুল আগ্রহের জন্ম দেন।
হলিউড-ও এই সময়ে আমাদের উপহার দেয় রহস্যময় জিনিসের সন্ধানে পৃথিবীর নানা বিপদসংকুল জায়গায় পাড়ি জমানো প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর ইন্ডিয়ানা জোন্স-এর কীর্তিকলাপ
রেলিক হান্টার বা টুম্ব রেইডার গোছের ভিডিও গেমস ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে

১৯৯৫, সালে ডগলাস প্রেস্টন ও লিংকন চাইল্ড টেকনো থ্রিলার ঘরানাতেই এমন একটি উপন্যাস লেখেন, যা ক্রিকটন-এর তোলপাড় ফেলা উপন্যাস “জুরাসিক পার্ক”-কেও ছাপিয়ে যায় তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু আভাস আর ইঙ্গিতের দিক দিয়ে।



এই কাহিনি শুরু হয় আমাজন অববাহিকার আপার জিংগু অঞ্চলে, যেখানে আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি-র ডক্টর জুলিয়ান হুইটলসে’র নেতৃত্বে, কিংবদন্তির উপজীব্য ‘কোথোগা’ জাতি এবং তাদের উপাস্য ‘লিজার্ড গড’ মবয়ুন (Mbwun)-এর সন্ধানে আসা একটি অভিযান মাঝপথেই পরিত্যক্ত হয়।
হুইটলসে-ও নিখোঁজ হয়ে যান। মিউজিয়ামের উদ্দেশে তিনি যেসব প্যাক করা ক্রেট পাঠিয়েছিলেন সেগুলো প্রথমে ব্রাজিলের বেলেমে পড়ে থাকে, তারপর জাহাজে চেপে গন্তব্যে এসে পৌঁছয়।
কিছুদিন পরে, মিউজিয়ামে এক বিশাল অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই, সেখানে এক নিরাপত্তা রক্ষী, আর বন্ধ হওয়া মিউজিয়ামে থেকে যাওয়া দুটি বাচ্চা ছেলে নৃশংসভাবে খুন হয়।
পুলিশ আসে, সঙ্গে আসেন ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের স্পেশাল এজেন্ট অ্যালয়সিয়াস পেন্ডারগাস্ট, যাঁকে গড়া হয়েছে পুরোপুরি শার্লক হোমসের আধুনিক, এবং ‘কুলেস্ট পসিবল’ সংস্করণ হিসেবেই। তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি যে বেলেমে একটি, এবং ক্রেটগুলো বয়ে আনা জাহাজে একাধিক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। অতঃপর শুরু হয় খুনি কে, বা কী, তা জানার, এবং তাকে আটকানোর চেষ্টা।
তারপর কী হল?
এক আদিম রহস্যের সঙ্গে আজকের শার্লক হোমসের টক্করের এই শ্বাসরোধী কাহিনিতে এরপর কী হল, তা জানতে চাইলে অবিলম্বে হস্তগত করুন ও পড়ে ফেলুন রেলিক” নামের এই বইটি!

কিন্তু তার পরেও তো কেটে গেছে আরো দু-দুটো দশক! হারানো জাতি বা শহরের সন্ধানে গিয়ে মাথা-খারাপ-করা রহস্য এবং প্রাণপাখি-ওড়ানো বিপদের মোকাবিলা করা ছেড়ে দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা কি তাহলে ঘরে বসে টিভি দেখাতেই মনোনিবেশ করেছেন?
না, তা হয়নি। হ্যাগার্ড, ডয়েল, ক্রিকটন-এর ঘরানার অনুসারী, এবং ফসেটের হার-না-মানা মানসিকতার যথার্থ বাহক হিসেবে জেমস রলিন্স-এর উপন্যাস “আমাজনিয়া” প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে।


শুধু জনপ্রিয় নয়, রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, এবং অ্যাকশন পছন্দ-করা পাঠকদের কাছে বইটি কাল্ট ক্লাসিক হয়ে যায় প্রকাশের পরেই।
কেন?
আমাজনের গভীরে নিখোঁজ হয়ে গেছিল র‍্যান্ড সায়েন্টিফিক এক্সপিডিশন। সেই দলের এক সদস্য, যে আবার স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সৈন্যও বটে, বেশ কয়েক বছর পর ক্ষতবিক্ষত ও মুমূর্ষু অবস্থায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, অভিযান শুরুর আগেই সে নিজের একটা হাত হারিয়েছিল, কিন্তু জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার পর দেখা গেল, তার দুটো হাত-ই আছে!
এই রহস্যের সমাধান করার জন্য যে অভিযান পাঠানো হয়, তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, এবং সৃষ্টিরহস্যের এক নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া এই উপন্যাস ক্লাসিক হবে না কেন?
ইতিহাস, বিজ্ঞান, অ্যাকশন, এবং সম্ভব-অসম্ভবের মাঝে দোলানো ভাবনা দিয়ে ঠাসা রচনার জগতের মুকুটহীন সম্রাট জেমস রলিন্স শুধু এই একটি বই লিখেই থেমে থাকেননি, একথা বলাই বাহুল্য। তাঁর একাধিক লেখাতেই পূর্বসূরিদের উদ্দেশে নরম স্যালুট স্পষ্ট হয়েছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি গোপন শাখা ‘সিগমা’ ফোর্স, যার সদস্যেরা আবার দুর্ধর্ষ বিজ্ঞানীও বটে, রলিন্স-এর নিজস্ব সৃষ্টি। এদের নানা কাহিনিতেই প্রাচীন রহস্যকে আধুনিক পৃথিবীতে জাগিয়ে তোলা হয়েছে অতুলনীয়ভাবে, যাদের মধ্যে দুটি লেখার কথা বলতেই হচ্ছে।


২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য সিক্সথ এক্সটিংশন” নামের এই টেকনো-থ্রিলারটি
জীবজগতের কিছু আদিমতম রহস্য, কিছু ‘যদি এমন হয়’ বা ‘হোয়াট ইফ’ পরিস্থিতি, আন্টার্কটিকার তুহিন অবাচী থেকে আমাজনের গভীরে জঙ্গলের মধ্যে এক ‘টেপুই’ বা টিলার বুকে রচিত এক ষড়যন্ত্র, এবং সেই মারাত্মক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঠেকাতে সিগমা ফোর্স ও অন্যান্যদের প্রাণপণ প্রয়াস নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি যদি এখনও না পড়ে থাকেন, তবে সেই ত্রুটি দ্রুত সংশোধন করতে অনুরোধ করব। তবে হ্যাঁ, পড়ার সময় অন্তত ঘন্টা ছয়েক ফাঁকা রাখবেন, নইলে জীবনে প্রগাঢ় অশান্তি গ্যারান্টিড।


২০১৫-য় প্রকাশিত হয় রলিন্স-এর উপন্যাস “দ্য বোন ল্যাবাইরিন্থ”।
মানবজাতির ইতিহাসের একটি রহস্য, মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্ব ও বিজ্ঞানচর্চা, আটলান্টিস নামক হারানো সভ্যতার বাস্তবতা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব, প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়ে ‘গোল্ডিলকস এনিগমা’ নামে খ্যাত প্রহেলিকা, এবং সমকালীন রাজনীতি ও বিজ্ঞানের পটভূমিতে আক্ষরিক অর্থে দম-আটকানো অ্যাডভেঞ্চার, এইসব নিয়ে সম্ভবত রলিন্সের সেরা উপন্যাস এটিই। তার চেয়েও বড়ো কথা, এই কাহিনির ক্লাইম্যাক্স মধ্য আমেরিকার এক রহস্যময় জঙ্গলে তো ঘটেইছে, তার সঙ্গে এই কাহিনিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সাইন-ল্যাংগুয়েজে দক্ষ ও অনেক মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, ‘বাকো’ নামের একটি গোরিলা!
এবং এক্ষেত্রেও আমি একই অনুরোধ করব: বইটা পড়ুন, তবে হাতে সময় নিয়ে। এটা মাঝপথে ছেড়ে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে হলে বা বাজারে ছুটতে হলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
তাহলে হে সুধী পাঠকবৃন্দ, আমি কি আপনাদের শিরায়-ধমনীতে রক্তচলাচল দ্রুততর করার পাশাপাশি অদ্ভুত কোনো জগতে কোনো অজানার সন্ধানে মনে-মনে ছোটার মতো কিছু ইন্ধন সরবরাহ করতে পারলাম?
যদি পেরে থাকি, তবে আমার এই দুর্বল লেখনী ত্যাগ করে উপরোক্ত ক্লাসিকপাঠে উদ্যোগী হোন। তাহলে ছুটিতে পাশের পাড়া বা দীঘায় যেতে হলেও আপনাদের যাবতীয় দুরন্ত আশা অপ্রত্যক্ষভাবে মেটানোর একটা সুযোগ আসবে, ফলে বাড়িতে শান্তি বজায় থাকবে।

আর যদি এই লেখা পড়ে “ধুর! কীসব বইয়ের কথা লিখেছে! এর চেয়ে আমার ‘কুন্দ ফুলের মালা’ বা ‘ভজগোবিন্দ’ দেখাই অনেক ভালো” মনে হয়, তাহলে অভাজনের অপরাধ নিয়েন না!
ভালো থাকুন।

Post a Comment

0 Comments