সফল উদ্যোক্তা হতে করতেই হবে এই ১০টি কাজ


দেশে একটি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হওয়ার পেছনে মূল কারণগুলোর একটি হলো উদ্যোক্তার অভাব। এই অভাবটি মূলত সৃষ্টি হয়েছে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে না পারার ভীতির কারণে। আমরা অনেকেই ভাবি যে একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে হয়তোবা প্রচন্ড রকমের সৃজনশীল হতে হবে কিংবা যুগান্তকারী একটি আইডিয়া থাকতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে সম্পূর্ণরূপে ওরকম না। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে কাজ করে আরো অনেকগুলো বিষয়। তার মধ্যে একটি হলো কর্মপরিকল্পনা গুলোর সঠিক বাস্তবায়ন।
তাহলে কি কি কাজ করলে একজন সাধারন মানুষ হতে পারবে একজন সফল উদ্যোক্তা? এই ব্যাপারগুলো পরিষ্কার ভাবে আপনাদের সামনে তুলে ধরতেই এই লেখাটি। চলুন জেনে নেই একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে অবশ্যই করণীয় ১০ টি কাজ সম্পর্কে।

১) লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট আগ্রহী হতে হবে:

সাফল্য অর্জনের জন্য যদি তীব্র পরিমাণে উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ না করে, তবে সেই কাজ যথা সময়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। উদ্যোক্তা হিসাবে যদি আপনার মাঝেই উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব কাজ করে, তাহলে ভেবে দেখুন এর প্রভাবে আপনার স্টার্টাপের অন্যান্য সদস্য এবং কাস্টমারের অবস্থা কী হবে। আপনার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখেই আপনার টিমের সদস্যরা অধিক কাজ করতে উৎসাহিত হবে। উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে যখন আপনি এবং আপনার টিম কাস্টমারদের সেবা প্রদান করবেন, তখন কাস্টমারের ও আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। কাস্টমারকে খুশী রাখাই একটি প্রতিষ্ঠান মূল উদ্দেশ্য। তাই কাস্টমার যখন আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি খুশি হবে, তখন আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন 

২) সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিন:

নিজের এবং প্রতিষ্ঠান এর সুযোগ সুবিধার দিকে নজর দিলে অযথা পরিশ্রমের অপচয় দূর করা সম্ভব। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানগুলো যে কাজটি করে থাকে সেটি হচ্ছে, যত কাজের সুযোগ পায় তত কাজই হাতে নিয়ে নেয়। এর ফলে যেটি হয়, অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে কোন কাজই সঠিকভাবে যথাসময়ে সম্পন্ন হয় না। এতে করে প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম হয়। ফলে কমে যায় গ্রাহক সংখ্যা। কারণ গ্রাহক যে কাজের জন্য মূল্য দিচ্ছে সেই কাজ যদি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন না হয়, তবে কেনই বা তারা পরবর্তীতে আবার একই প্রতিষ্ঠান ধার ধারবে?
তাই একগাদা কাজ হাতে নিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলার চেয়ে যতটুকু কাজ ঠিকভাবে করার সুযোগ রয়েছে ঠিক ততটুকু কাজই হাতে নিতে হবে। এতে করে কর্মচারীদের উপর যেমন চাপ কমবে তেমনি সঠিক এবং সুন্দর কাজের জন্য বাড়বে গ্রাহক সন্তুষ্টি। তাই যে কোনো কাজ হাতে নেয়ার ক্ষেত্রে সেই কাজটি করার জন্য প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৩) কঠোর পরিশ্রম করুন:

একটি জিনিস আমাদের সবার মাথায় ভালো করে গেঁথে নেয়া দরকার। আর সেটি হচ্ছে সফলতা কোন সময়ই রাতারাতি অর্জিত হয় না। আমরা অনেককে রাতারাতি সফল হতে দেখে এই ভুল ধারণাটি আমাদের মাঝে জন্মে যায়। কিন্তু সাফল্যের পিছনে যে কত রাতের পরিশ্রম রয়েছে সেটি আমরা জানার চেষ্টা করি না। ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে সাফল্যের ছোঁয়া পাওয়া বড়ই মুশকিল।
কঠোর পরিশ্রম দ্বারা ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারলেই হাতে ধরা দেবে সাফল্য। একজন সফল উদ্যোক্তা সকল কাজে নিজের সর্বোচ্চটুকু দেয়। আপনি যদি লক্ষ্য অর্জনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তবে আপনার হতাশ হওয়ার কোন কারণই নেই। সাফল্য কোন না কোন সময় আপনার কাছে ধরা দেবেই।

৪) উপভোগ করতে শিখুন:

লক্ষ্যের পেছনে ছুটে যেতে আপনাকে সবাই বলবে, কিন্তু সফল মানুষ আপনার সেই ছুটে যাওয়ার পথকে উপভোগ করতে শেখাবে। তারা আপনাকে শেখাবে চূড়ান্ত সাফল্যের পথে প্রতিটি অর্জনকে উদযাপন করতে। জীবনের অধিকাংশ মূল্যবান সময় লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে সেই সময়টা যদি উপভোগই করতে না পারেন তবে কী লাভ সেই লক্ষ্য অর্জন করে? লক্ষ্য অর্জনের পথটা যদি উপভোগ্য হয় তাহলে আপনি এবং আপনার টিম কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে। এর ফলে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারুন কিংবা না পারুন, কোন কাজ করা নিয়ে আপনার কিংবা আপনার টিমের মাঝে কোন ধরনের হতাশা কাজ করবে না।

৫) নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করুন:

বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই কাগজে কলমের যুক্তিতে মিলে না। কাগজ কলম এর হিসাব অনেক সময় আমাদের ভুল নির্দেশনা দেয়। এই হিসাব গুলো যদি আমাদের কল্পনার সাথে মিলে যায় তাহলে আমাদের মনে হয় এটাই বুঝি একমাত্র সমাধান। কিন্তু আসলে তা নয়। সাফল্যের আ আরও অনেক রাস্তা রয়েছে। সেই রাস্তা গুলো খুঁজে পেতে হয় নিজের বিচার-বিবেচনা দ্বারা। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন। যদি আপনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেন তাহলে আপনার বিবেক আপনাকে ভুল নির্দেশনা দিবে না। নিজেকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করলে আপনারা সিদ্ধান্তগুলো যথার্থ হবে না।

৬) নমনীয় হন তবে লক্ষ্য অর্জনে অটল থাকুন:

প্রত্যেক উদ্যোক্তা কেই সব সময় সব সময় চটপটে থাকতে হয়। নতুন তথ্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় এবং সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে হয়। আবার সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে থাকতে হয় সদা অটল। এখানেও বিবেক কাজে লাগে। প্রতিষ্ঠানিক কোন কোন পরিবর্তন আনলে তা লাভজনক হবে আবার কোন কোন পরিবর্তন আনলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হবে তার জন্য বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে হবে।
যদি আপনি দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করেন যে পরিবর্তন আনা উচিত তাহলে তা অবশ্যই করবেন। অন্যথায় আপনি এবং আপনার প্রতিষ্ঠান হতে পারেন ক্ষতির সম্মুখীন। অর্থাৎ যেই বিষয় গুলোতে নমনীয় হলে বাড়বে আপনার লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা, সেই বিষয়গুলোকে চিনতে পেরে নমনীয় হতে পারতে হবে।

৭) টিমের উপর নির্ভর করতে শিখুন:

একজন মানুষ এর পক্ষে সকল বিষয়ে পারদর্শী হওয়া সম্ভব নয়। যে যেই কাজটি পারে না তার সে কাজটি করে দেয়ার জন্য সেই বিষয়ে দক্ষ অন্য একজন মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয়। উদ্যোক্তারা সাধারনত এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয় যে তারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে কোন কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব না। এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগে। তবে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে হলে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে হবে এই ভুল ধারণা থেকে।
প্রথমে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে নিজের দক্ষতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করতে হবে। তারপর যেসব বিষয় আপনার অন্যান্য দক্ষ মানুষের সাহায্য লাগবে সেই বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। তারপর খুঁজে বের করতে হবে সেই বিষয়গুলোতে দক্ষ কিছু মানুষ। নিজের মত মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু নিজের চেয়ে ব্যতিক্রম মানুষ যারা কিনা ভিন্ন বিষয়ে দক্ষ, তাদের খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন একটি কাজ। এই কঠিন কাজটি যদি আপনি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন তবে আপনি আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়ার দিকে।

৮) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করুন:

আপনি যদি সাধারণ কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি এখন যে কাজটি করার কথা ভাবছেন সেই কাজটির আইডিয়া স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মাথায় আসার কথা। সফলতা অর্জনের জন্য যে চমকপ্রদ কোন আইডিয়া প্রয়োজন তা কিন্তু সব সময় সত্য নয়। অতি সাধারণ একটি আইডিয়ার খুব চমৎকার একটি বাস্তবায়ন এনে দিতে পারে অসাধারণ সাফল্য। খেলাধুলার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরিকল্পনা দ্বারাই কিন্তু খেলা জেতা যায় না। খেলা জেতার জন্য প্রয়োজন মাঠে নেমে যখন যা প্রয়োজন তা করতে প্রস্তুত থাকা।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় একই রকম। দেখা গেল যে আপনি আপনার স্টার্টআপের জন্য অনেক অনেক পরিকল্পনা করলেন, পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড বানিয়ে ভরিয়ে ফেললেন, কিন্তু এত এত পরিকল্পনার কোনো সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করলেন না। তাহলে কি লাভ হল এত কিছুর? কি করবেন এতো পরিকল্পনা দিয়ে?
অথবা দেখা গেল পরিকল্পনা করতে গিয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে ফেললেন। ফলে তা বাস্তবায়নের জন্য পেলেন খুবই স্বল্প সময়। বাস্তবায়ন করার সময় দেখা গেল আপনি আপনার ব্যবসার পরিবেশ যে রকম ভেবেছিলেন এখন আর সেরকম নেই। ফলে পূর্বের পরিকল্পনা খুব একটা কাজে আসছে না। পরিবর্তন আনতে হচ্ছে পরিকল্পনায়। কিন্তু আপনি প্রথম পরিকল্পনাতেই এত সময় ব্যয় করে ফেললেন যে নতুন পরিকল্পনা করার জন্য আপনার হাতে যথেষ্ট সময় নেই। এতে করে আপনার পুরো ব্যবসাটি বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
তাই পরিকল্পনার পেছনে খুব বেশি সময় অপচয় না করে বাস্তবায়নে নেমে পড়ুন। কারণ ব্যবসা করতে মাঠে নামলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে পারা যায় এবং সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনা যায়। আর বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক নতুন জিনিস শিখতে পারা যায় যা পরবর্তীতে ব্যবসায়িক কাজে সহায়তা করবে। খেয়াল রাখবেন পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনার প্রতিষ্ঠান কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন আনতেও যেন আপনি সদা প্রস্তুত থাকেন। এতে বাড়বে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা।

৯) সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করুন:

ভন্ডামি করে হয়তোবা সাময়িক সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু এই সাফল্য বেশিদিন বিদ্যমান থাকে না। আপনি দেখবেন যেসব প্রতিষ্ঠান তার গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করেছে সে সব প্রতিষ্ঠান সাময়িক ভাবে বেশ লাভবান হলেও তাদের পতনও খুব দ্রুত ঘটেছে। দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের জন্য যে দুটি গুণ প্রয়োজন তা হচ্ছে সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা
আপনার কর্মকাণ্ডে এই দু’টি কোন প্রকাশ পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করুন আপনার বিবেককে প্রশ্ন করার মাধ্যমে। এ দুটি গুণ কোন যদি আপনার মাঝে থাকে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড গুলো যদি আপনি সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারেন তবে সফলতা আপনার থেকে খুব বেশি দূরে নেই।

১০) প্রতিদান দিতে শিখুন:

এই অংশটি ভুলে গেলে চলবে না। যখন আপনার কর্মকাণ্ডে এই ব্যাপারটি ফুটে উঠবে তখনই কেবল মাত্র আপনি নিজেকে সফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন। আপনি যখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে থাকবেন তখন খেয়াল করে দেখবেন অনেক মানুষ আপনার এই সফলতার পিছনে অবদান রেখেছে। আমরা অনেক সময়ই আমাদের সফলতার পিছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের সবাইকে এর প্রতিদান দিতে পারি না। কারণ অধিকাংশ সময় তাদের সবাইকে আমরা চিনতেই পারি না।
তাদের অনেকেই নীরবে সংগোপনে আমাদের সাহায্য করে গিয়েছেন। তাই তাদের এই অবদানের প্রতিদান হিসেবে যখন যাকে পারবেন তাকেই সাহায্য করবেন। যখন আপনি সফল হবেন তখন সমাজের প্রতি আপনার একটি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই দায়বদ্ধতা থেকে আপনি আপনার সাধ্যের মধ্যে মানুষকে যতোটুকু সাহায্য করতে পারবেন তার মাধ্যমেই আপনার প্রকৃত সফলতা বিচার করা যাবে।
এই ১০ টি কাজ ঠিকভাবে করতে পারলে আপনি হতে পারবেন উদ্যোক্তা হিসেবে সফল। কিন্তু সফলতা আসলে কি? এর উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকম। এর কোন সার্বজনীন পরিমাপ নেই। বিল গেটস যেমন তার চোখে সফল, তেমনি মাদার তেরেসাও নিজের চোখে সফল। তাই আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনার কাছে সফলতা মানে কি।
আমার মতে সফলতার মাপকাঠি কখনোই আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হওয়া উচিত নয়। এই মাপকাঠি হওয়া উচিত কতগুলো মানুষের জীবনে আপনি পরিবর্তন আনতে পেরেছেন তার সংখ্যা। আমাদের সফলতার অভিযানে এই মাপকাঠি প্রয়োগ করলে যেমন আমরা প্রকৃত সাফল্য অর্জন করতে পারবো তেমনি আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশটাকে করতে পারবো আরও সুন্দর।

Post a Comment

0 Comments