১।
কিছুদিন আগে ঠিক এই ইংরেজি শিরোনামে একটা বক্তব্যের ভিডিও দেখেছিলাম (লিংক
শেষে)। অসাধারণ এই বিশ্লেষনটা আমি পরে পরিচিত অনেক জনকেই দেখিয়েছি। এই
বক্তব্য যিনি দিয়েছেন তাঁর নাম Simon O. Sinek – একজন ব্রিটিশ-আমেরিকান
লেখক এবং মোটিভেশনাল বক্তা (জন্মসাল: ১৯৭৩)। তাঁর লেখা তিনটা বই আছে। আচ্ছা
এবার মূল বিষয়ে ফেরত আসি: এইখানে তাঁর বক্তব্যের একটা কাছাকাছি বাংলা
দেয়ার চেষ্টা করছি কারণ: মনে হয়েছে যাদের দেখার সুযোগ হয়নি বা ইংরেজিতে
সমস্যা তাঁরা এই বিশ্লেষনটা জানুক।
২।
এবার আসি সংক্ষেপে সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনটিতে:
বর্তমানের যে প্রজন্ম অর্থাৎ ৮৪ সাল বা এর পরে যাদের জন্ম তাঁদের চারটা বৈশিষ্ট আছে যা আগের প্রজন্মগুলো থেকে সম্পুর্ন আলাদা। এঁদের নামে অনেক অভিযোগ – এরা নবাবজাদা মানসিকতার; এদেরকে ম্যানেজ করা কঠিন; এরা আত্নকেন্দ্রীক; লক্ষ্যহীন; অলস ইত্যাদি।
এঁদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়: জীবনে কী হতে চাও? এঁদের জবাব হবে - আমি একটা মহৎ কাজ করতে চাই; সবার জীবনে প্রভাব ফেলতে চাই (বিখ্যাত?), ফাও খেতে চাই ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা যা চায় সেগুলো দেয়া হলে, এমনকি ফ্রী খাইতে দিয়েও তাদেরকে খুশি করা যায় না দেখা যায় কিছু একটা বাকী আছে। এরকম হওয়ার পেছনে চারটি মূল কারণ বের করেছেন তিনি।
প্রথম কারণ হল ভুলভাবে বাচ্চা লালন-পালন। এদের বেশিরভাগের বাবা-মাগণ ছোটকাল থেকে এঁদেরকে বার বার বলেছে যে তাঁরা স্পেশাল; বলেছে যে তোমরা যা হতে চাও তাই হতে পারবে - ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে শুধুমাত্র চাইলেই হবে; কিন্তু এর জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে সে ব্যাপারে কিছুই বলে না। এদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কারণ এমন নয় যে এরা এর যোগ্য (মানে রেজাল্ট এ্যাত ভাল যে উচ্চতর ডিগ্রী করানো যায়), কারণ হল এটা এঁদের বাবা-মা’ চায় তাই। কেউ কেউ ক্লাসে এ গ্রেড পেয়ে এসেছে - যোগ্যতার কারণে নয়, বরং এই কারণে যে শিক্ষক এঁদের অতি নাক-গলানো স্বভাবের বাবা-মা’কে এড়াতে চায়। কেউ কেউ এমনকি ক্লাসে দেরিতে আসার জন্যও পুরষ্কার পায় – কাজেই যা হয় তা হল যারা সত্যিই পরিশ্রম করে তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে - পরিশ্রম করার আগ্রহ কমে যায়। আর যে শেষে আসার জন্য পুরষ্কার পায় সে একটু বিব্রত বোধ করে - কারণ সে জানে সে পুরষ্কারের যোগ্য না; তাই হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু এই গ্রুপের পোলাপানগুলো যখন বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এঁরা দেখে - তাঁরা মোটেও স্পেশাল নয়; মামা-চাচার লবিং ছাড়া প্রমোশন পাচ্ছে না; দেরিতে বা শেষে আসার জন্য কোন পুরষ্কার নাই; আর শুধুমাত্র চাচ্ছে বলেই কোন কিছু পাওয়া যায় না – ফলে মুহুর্তেই তার নিজেকে নিয়ে গড়া স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। ফলে একটা পুরা প্রজন্ম, তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি হীনমন্যতা নিয়ে বড় হচ্ছে।
৩।
দ্বিতীয় কারণ হল বাধাহীনভাবে সামাজিক মাধ্যম যথা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। লোক-দেখানি ভাব নিতে এগুলোর জুড়ি নাই। অসাধারণ জীবন যাপনের একটা ভূয়া ভাব নেয়া যায় সেখানে, যদিও যে চরম ভাব নিচ্ছে আদতে হয়তো তাঁর মন খারাপ। ফলে এখানে ঘুরলে মনে হয় সবাই কী দারুন জীবন যাপন করছে, আর তাদের কথাবার্তা দেখলে মনে হয় জীবনে তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে যা বাস্তবের পুরা বিপরীত। আরেকজনের কাজ কারবার দেখলে মনে হয় আমারও এমনই করতে হবে - কিন্তু আদতে সেরকম হওয়া বা করা সম্ভব না। ফলে হীনমন্যতায় ভোগা একটা প্রজন্ম আরো বেশি হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে - যদিও এতে তাঁদের কোন দোষ ছিল না।
একজনের হয়ত কিচ্ছু করার নাই, বা ভাল লাগছে না - তাই মেসেঞ্জারে গ্রুপকে লিখলো “হাই ...”। একটু পরেই আবার মেসেজ চেক করে দেখে দশটা রেসপন্স এসেছে …. “হাই”, “হাই”, “হাই”, “হাই” … … … … … । এতে আসলে কী হল!? মনে হল কিছুই না, কিন্তু আসলে এটাতে প্রথম ব্যক্তির বেশ ভাল লাগলো। এই যে ভাল লাগা, এই অনুভুতিটার পেছনে একটা হরমোন কাজ করে - যেটার নাম হল ডোপামিন। এজন্যই আমরা বার বার চেক করি, কয়টা লাইক পড়লো, কয়টা রেসপন্স আসলো ইত্যাদি। অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ ঘটাতে সাহায্য করে। তবে জেনে রাখা ভাল, এই সামাজিক যোগাযোগের ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া আরো অনেক যে যে জিনিষগুলো আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায় সেগুলোর মধ্যে আছে – সিগারেট, মদ, জুয়া এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্য। অর্থাৎ মাদকতার আনন্দ যে ডোপামিনে, যা আসক্তি সৃষ্টি করে - ঠিক সেই একই রকম আসক্তি এই সামাজিক মাধ্যম সৃষ্টি করে। ছোটরা যেন অবুঝের মত আক্রান্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য বিদেশে মদ, সিগারেট কিনতে এবং জুয়া খেলতে বয়সের বিধিনিষেধ আছে - দোকানে নির্দিষ্ট বয়েসের কমবয়সী কেউ সেগুলো কিনতেই পারে না; অথচ একই রকম আসক্তিদায়ক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বাচ্চাদের কোনো বাধা নাই। এর মানে হল অনেকটা এরকম: একজন কিশোরকে বা বালককে নিজের সিগারেট প্যাকেটে/মদের ভাণ্ডারে বাধাহীন অধিকার দেয়া।
৪।
কাজেই এই প্রজন্ম বিশেষত কৈশোরের মানসিক পরিবর্তনের সময়ে যখন বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক চাপ সামলাতে খাবি খায় তখন তাঁদের সামনে এরকম একটা নেশাদ্রব্য দিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই চাপ ভুলে থাকার জন্য। সেই আবেগ মানসিক চাপ ইত্যাদি সামলাতে যখন বাবা-মা কিংবা বন্ধুদের সাহায্য দরকার ছিল, তখন তাঁরা নেশার সাহায্য নেয় – নেশা মানে এই সামাজিক মাধ্যম – ফেসবুক ইত্যাদি। আর এই ব্যাপারটা যখন তাঁদের মাথায় গেঁথে যায়, তখন জীবনের যে কোন পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতীক কিংবা পেশাগত চাপ সামলাতে তাঁরা কোন বন্ধু বা গুরুজনের কাছে সাহায্য চাওয়ার বদলে নেশার বোতল তথা ফেসবুক টাইপের জিনিষপাতি খুলে বসে। আর এ-তো জানা কথাই, নেশা কখনই দীর্ঘমেয়াদে ভাল কিছু করতে পারে না; এটা জীবন ধ্বংসকারী একটা বস্তু।
আর এই আসক্তির কারণে দেখা যায়, এই প্রজন্মের বড় একটা অংশ সত্যিকারের বন্ধুত্ব, গভীর সম্পর্কের অর্থই বোঝে না। তাদের বন্ধুত্বগুলো ভাসা ভাসা; যে বন্ধুর উপর নির্ভর করা যায় না – আর এমনও হতে পারে যে মজা শেষে তাকে খুব সহজেই আনফ্রেন্ড করে দিতে পারে। বাস্তব জীবনে ঝগড়া, মারামারি, মান অভিমানে যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা সেরকম গভীর বন্ধুত্ব হওয়ার মত সুযোগই তাদের হয়না। বন্ধু তৈরীর যে পথ, যে কৌশল: সেটা শেখারই কোন সুযোগ তারা পায় না। আর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন চাপ সামলাতে নেশাতে ডুবে যাওয়া ছাড়া তাদের উপায়ও থাকে না।
নেশার যে দ্রব্যগুলো - সেগুলো কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারেই নেশা হয়। বুঝে শুনে সীমিত পরিসরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সেগুলো কিন্তু আনন্দের উৎস হতে পারে। কিন্তু এই সময়ে যেটা হচ্ছে ২৪ ঘন্টাই সেলফোনের প্রভাবে নেশাগ্রস্থ থাকছে একটা প্রজন্ম। আরেকজনের দিকে মাথা তুলে তাকানোর পর্যন্ত সময় নাই। খুব জরুরী দুই একটা কথার বাইরে যে কেমন আছেন, মুরগী ডিম পারছে কি না, কিংবা বাসায় মশার উপদ্রব – বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক তৈরীর শুরুতে জরুরী এই জাতীয় নির্দোষ আলাপচারিতা করার মত সময় বা দক্ষতা তাদের থাকেনা। বন্ধুদের সাথে খেতে বসে যদি সেদিকে মনযোগ না দিয়ে আরেকজনের সাথে ফোনে চ্যাট করতে থাকে কেউ – তাহলে সেটা অবশ্যই একটা নেশা, একটা সিরিয়াস সমস্যা। একটা অফিসিয়াল মিটিংএ যদি মনোযোগটা ফোনের মেসেজে বেশি থাকতে হয়, তাহলে সেটা সমস্যা। ঘুম থেকে উঠে পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের খবর নেয়ার আগে যদি ফোনের মেসেজ চেক করে কেউ – তাহলে সেটা নেশা – অবশ্যই একটা সমস্যা।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যাদের আত্মসম্মানবোধ গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি; আরও দেখা যাচ্ছে চাপ সামলানোর টেকনিকগুলো শেখার সুযোগ আমরা তাদেরকে দেই নাই – নেশাগ্রস্থ হওয়াটা কোন টেকনিক হতে পারে না।
৫।
এবার আসা যাক তৃতীয় কারণে (যেটার সমস্যাটা হল অসহিষ্ণুতা) – তাৎক্ষনিকভাবে চাহিদা মিটে যাওয়ার অভ্যাস। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কেউ কিছু কিনতে চাইলে আয়োজন করে টাকা পয়সা জোগাড় যন্ত্র, হাটের দিন কবে ইত্যাদি খোঁজ নিয়ে সময় করে বাজার/হাটে যেতে হয় না; অনলাইনে তখনি কিনে ফেলতে পারে, টাকা না থাকলে অসুবিধা নাই – কারণ এজন্য ক্রেডিট কার্ড আছে, পেমেন্ট অন ডেলিভারি আছে, ইনস্টলমেন্টের সুবিধা আছে; আর একদিনের মধ্যেই সাধারণত জিনিষটা বাসায় চলে আসে। কেউ সিনেমা দেখতে চাইলে ইউটিউব বা অন্য মিডিয়াতে সাথে সাথে দেখতে পারে, কিংবা পে-চ্যানেলে গিয়েও দেখতে পারে। সিনেমাটা কাছের সিনেমাহলে আছে কি নাই, শো-এর টাইমটেবল, টিকেট আছে কি না – এসব নিয়ে কোন ঝামেলাই নাই। একটা টিভি সিরিজ দেখার ইচ্ছা হলে সাথে সাথেই ইন্টারনেটে সেটা দেখে ফেলা যায়। পরের পর্বের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস অপেক্ষার ফলে সহিষ্ণুতার যে শিক্ষা সেটার কোন বিষয়ই আর নাই এখন। কেউ কেউ তো আবার এতই অধৈর্য যে, মাঝের পর্ব বাদ দিয়ে একেবারে সিজনের শেষ পর্ব দেখে ফেলে।
এমনকি, কাউকে প্রপোজ করাটাও এখন এঁরা শিখতে পারে না। কিভাবে হাত ঘষে ঢোক গিলে বোকা বোকা কথা শুরু করবে ডিজিটাল যুগে এধরণের সামাজিকতা শেখারও প্রয়োজন নাই। ডেটিং সাইটে গিয়ে শুধু ক্লিক করলেই সব ঠিক। এই যুগে যাই চাওয়া হয়, সাথে সাথে পাওয়া যায়, শুধুমাত্র যা পাওয়া যায়না সেটা হল – পেশাদারিত্ব আর গভীর সম্পর্ক। কারণ, এগুলোর জন্য কোন অ্যাপ নাই। এগুলোর অর্জন হয় ধীরগতির, আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথে – যা পেরোতে দরকার ধৈর্য আর একাগ্রতা। কিন্তু এই প্রজন্মের এই অর্জনগুলোর জন্য যে প্রশিক্ষণের দরকার ছিল তা হয়নি। কর্মস্থলে গিয়ে এরা হতাশ হয়, গভীর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয় / পিছিয়ে যায়: কারণ ধৈর্য ধরে সফলতার জন্য অপেক্ষা আর লেগে থাকা, তিল তিল করে সফলতার ভিত্তি গড়ে তোলা বা কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চর্চা - এ ধরণের কোন প্রশিক্ষণই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এরা পায় না। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে চূড়াতে যাওয়ার কামনার মত – এঁরা শুধু চূড়া দেখে আর সরাসরি সিরিয়ালের শেষ পর্ব দেখার মত স্টাইলে সেখানে যেতে চায়। কিন্তু বাস্তব তো এমন নয়: এর জন্য পাহাড় ডিঙানোর পরিশ্রম, ধৈর্য, পরিকল্পনা, দক্ষতা এইসব দরকারী বিষয়গুলোর কোন ধারণাই এদের মধ্যে থাকে না। ফলাফল আরো বেশি হতাশা, হীনমন্যতা।
এইসব কারণে হতে পারে যে সমাজে আত্মহত্যা, মাদকাসক্তির হার বেড়ে যাবে। ডিপ্রেশনের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার হার বেড়ে যাবে। মন্দের ভাল হিসেবে সবচেয়ে ভাল যেটা হতে পারে, তা হল: পুরা সমাজের একটা বড় অংশ রোবটের মত একঘেয়ে একটা জীবন পার করবে কিন্তু কখনই জীবনের আনন্দঘন দিকগুলো সেভাবে উপভোগ করতে পারবে না। কখনই তাদের মধ্যে জীবনবোধের গভীরতা কিংবা পরিপূর্ণতার অনুভূতি আসবে না।
৬।
শেষ বা চতূর্থ পয়েন্টটা হল পরিবেশ। কর্পোরেট কালচারেও সবকিছু স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে করা হয়। এঁরা যে নতুন কর্মী যোগ দিয়েছে তার কোন উন্নয়ন হল কি না সেটা মোটেও ভাবে না বরং নিজেদের স্বল্পমেয়াদী অর্জনের লক্ষ্য ঠিক আছে কি না সেটা নিয়েই চিন্তিত। এটা এমনই একটা পরিবেশ যেটা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে মোটেই সাহায্য করছে না। এই কর্পোরেট পরিবেশ তাদেরকে পারস্পরিক আস্থা, বন্ধুত্ব স্থাপনের যে কৌশল তা শিখতে সাহায্য করছে না। অসহিষ্ণুতা থেকে বেরিয়ে আসতে যে প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং দরকার – ধৈর্যধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যস্থির করে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার – সেটার কোন ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে না এই কর্পোরেট সংস্কৃতি। যে ধরণের অর্জনগুলো করতে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে এক লক্ষ্যে কাজ করতে হয় এবং সেটা অর্জনের পর যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটা অনুভব করার কোন সুযোগই তাদেরকে এখানে দেয়া হয় না। এসব কারণে দিনকে দিন তারা আরও হতাশ হয়ে যায়, মনে করতে থাকে তাঁদের কোন যোগ্যতাই নাই।
বাব-মা’র ভুল, সমাজ-ব্যবস্থার ভুলের ফলে এই প্রজন্ম ক্রমেই আত্মকেন্দ্রীক, অসহিষ্ণু এবং অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে – অথচ তার দায় কেউ নিতে রাজি হয় না। … … … …
৭।
সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনের পরিপ্রেক্ষিতের সাথে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত হয়তো পুরাপুরি মিলবে না। কিন্তু কিছুটা শিক্ষনীয় চিন্তা-জাগানিয়া বিশ্লেষনী দৃষ্টিভঙ্গি যে সেখানে আছে - সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। এই যে আমাদের পোলাপানগুলোকে না চাইতেই গণহারে উচ্চতম জিপিএ দিয়ে পাশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটার দীর্ঘমেয়াদে প্রায় একই রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার কথা। কারণ এতে যাঁরা সত্যিকারের পড়াশোনা করতো তাঁরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তেল আর ঘি’য়ের যখন একই মূল্যায়ন হবে তখন কেন কষ্ট করে ঘি উৎপাদন করবে কেউ? আর এই না চাইতেই পাওয়ার ফলে তাঁদের অবচেতন মনে এমন ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে যে এই ডিগ্রীগুলো ছেলের হাতের মোয়া, সহজলভ্য বস্তু - যা না চাইতেই পাওয়া যায়। এর জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায় এসবের কোন প্রয়োজন নাই। শুধু আসবো যাবো, ফূর্তি করবো, ফেসবুকিং করবো, চকচকে ক্যাম্পাসে ফ্যাশন করে ছবি তুলবো – কয়দিন পর প্রসেসের কারণে ডিগ্রী এমনিই পাওয়া যাবে।
জানি, উচ্চশিক্ষার কিছু জায়গায় এই চর্চাটাই চলছে। কিন্তু অবচেতন মনে হীনমন্যতা ঢুকে আত্মসম্মানবোধহীন যে প্রজন্ম আমরা তৈরী করছি তাতে করে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। কর্মক্ষেত্রে এঁদের বড় অংশ শুধু খাবি খাবে। কোত্থাও টিকতে পারবে কি না জানিনা, তবে হতাশা বাড়তেই থাকবে।
==
ইউটিউবে সাইমন ভাইয়ের ভিডিও লিংক
২।
এবার আসি সংক্ষেপে সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনটিতে:
বর্তমানের যে প্রজন্ম অর্থাৎ ৮৪ সাল বা এর পরে যাদের জন্ম তাঁদের চারটা বৈশিষ্ট আছে যা আগের প্রজন্মগুলো থেকে সম্পুর্ন আলাদা। এঁদের নামে অনেক অভিযোগ – এরা নবাবজাদা মানসিকতার; এদেরকে ম্যানেজ করা কঠিন; এরা আত্নকেন্দ্রীক; লক্ষ্যহীন; অলস ইত্যাদি।
এঁদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়: জীবনে কী হতে চাও? এঁদের জবাব হবে - আমি একটা মহৎ কাজ করতে চাই; সবার জীবনে প্রভাব ফেলতে চাই (বিখ্যাত?), ফাও খেতে চাই ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা যা চায় সেগুলো দেয়া হলে, এমনকি ফ্রী খাইতে দিয়েও তাদেরকে খুশি করা যায় না দেখা যায় কিছু একটা বাকী আছে। এরকম হওয়ার পেছনে চারটি মূল কারণ বের করেছেন তিনি।
প্রথম কারণ হল ভুলভাবে বাচ্চা লালন-পালন। এদের বেশিরভাগের বাবা-মাগণ ছোটকাল থেকে এঁদেরকে বার বার বলেছে যে তাঁরা স্পেশাল; বলেছে যে তোমরা যা হতে চাও তাই হতে পারবে - ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে শুধুমাত্র চাইলেই হবে; কিন্তু এর জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে সে ব্যাপারে কিছুই বলে না। এদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কারণ এমন নয় যে এরা এর যোগ্য (মানে রেজাল্ট এ্যাত ভাল যে উচ্চতর ডিগ্রী করানো যায়), কারণ হল এটা এঁদের বাবা-মা’ চায় তাই। কেউ কেউ ক্লাসে এ গ্রেড পেয়ে এসেছে - যোগ্যতার কারণে নয়, বরং এই কারণে যে শিক্ষক এঁদের অতি নাক-গলানো স্বভাবের বাবা-মা’কে এড়াতে চায়। কেউ কেউ এমনকি ক্লাসে দেরিতে আসার জন্যও পুরষ্কার পায় – কাজেই যা হয় তা হল যারা সত্যিই পরিশ্রম করে তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে - পরিশ্রম করার আগ্রহ কমে যায়। আর যে শেষে আসার জন্য পুরষ্কার পায় সে একটু বিব্রত বোধ করে - কারণ সে জানে সে পুরষ্কারের যোগ্য না; তাই হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু এই গ্রুপের পোলাপানগুলো যখন বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এঁরা দেখে - তাঁরা মোটেও স্পেশাল নয়; মামা-চাচার লবিং ছাড়া প্রমোশন পাচ্ছে না; দেরিতে বা শেষে আসার জন্য কোন পুরষ্কার নাই; আর শুধুমাত্র চাচ্ছে বলেই কোন কিছু পাওয়া যায় না – ফলে মুহুর্তেই তার নিজেকে নিয়ে গড়া স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। ফলে একটা পুরা প্রজন্ম, তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি হীনমন্যতা নিয়ে বড় হচ্ছে।
৩।
দ্বিতীয় কারণ হল বাধাহীনভাবে সামাজিক মাধ্যম যথা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। লোক-দেখানি ভাব নিতে এগুলোর জুড়ি নাই। অসাধারণ জীবন যাপনের একটা ভূয়া ভাব নেয়া যায় সেখানে, যদিও যে চরম ভাব নিচ্ছে আদতে হয়তো তাঁর মন খারাপ। ফলে এখানে ঘুরলে মনে হয় সবাই কী দারুন জীবন যাপন করছে, আর তাদের কথাবার্তা দেখলে মনে হয় জীবনে তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে যা বাস্তবের পুরা বিপরীত। আরেকজনের কাজ কারবার দেখলে মনে হয় আমারও এমনই করতে হবে - কিন্তু আদতে সেরকম হওয়া বা করা সম্ভব না। ফলে হীনমন্যতায় ভোগা একটা প্রজন্ম আরো বেশি হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে - যদিও এতে তাঁদের কোন দোষ ছিল না।
একজনের হয়ত কিচ্ছু করার নাই, বা ভাল লাগছে না - তাই মেসেঞ্জারে গ্রুপকে লিখলো “হাই ...”। একটু পরেই আবার মেসেজ চেক করে দেখে দশটা রেসপন্স এসেছে …. “হাই”, “হাই”, “হাই”, “হাই” … … … … … । এতে আসলে কী হল!? মনে হল কিছুই না, কিন্তু আসলে এটাতে প্রথম ব্যক্তির বেশ ভাল লাগলো। এই যে ভাল লাগা, এই অনুভুতিটার পেছনে একটা হরমোন কাজ করে - যেটার নাম হল ডোপামিন। এজন্যই আমরা বার বার চেক করি, কয়টা লাইক পড়লো, কয়টা রেসপন্স আসলো ইত্যাদি। অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ ঘটাতে সাহায্য করে। তবে জেনে রাখা ভাল, এই সামাজিক যোগাযোগের ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া আরো অনেক যে যে জিনিষগুলো আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায় সেগুলোর মধ্যে আছে – সিগারেট, মদ, জুয়া এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্য। অর্থাৎ মাদকতার আনন্দ যে ডোপামিনে, যা আসক্তি সৃষ্টি করে - ঠিক সেই একই রকম আসক্তি এই সামাজিক মাধ্যম সৃষ্টি করে। ছোটরা যেন অবুঝের মত আক্রান্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য বিদেশে মদ, সিগারেট কিনতে এবং জুয়া খেলতে বয়সের বিধিনিষেধ আছে - দোকানে নির্দিষ্ট বয়েসের কমবয়সী কেউ সেগুলো কিনতেই পারে না; অথচ একই রকম আসক্তিদায়ক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বাচ্চাদের কোনো বাধা নাই। এর মানে হল অনেকটা এরকম: একজন কিশোরকে বা বালককে নিজের সিগারেট প্যাকেটে/মদের ভাণ্ডারে বাধাহীন অধিকার দেয়া।
৪।
কাজেই এই প্রজন্ম বিশেষত কৈশোরের মানসিক পরিবর্তনের সময়ে যখন বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক চাপ সামলাতে খাবি খায় তখন তাঁদের সামনে এরকম একটা নেশাদ্রব্য দিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই চাপ ভুলে থাকার জন্য। সেই আবেগ মানসিক চাপ ইত্যাদি সামলাতে যখন বাবা-মা কিংবা বন্ধুদের সাহায্য দরকার ছিল, তখন তাঁরা নেশার সাহায্য নেয় – নেশা মানে এই সামাজিক মাধ্যম – ফেসবুক ইত্যাদি। আর এই ব্যাপারটা যখন তাঁদের মাথায় গেঁথে যায়, তখন জীবনের যে কোন পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতীক কিংবা পেশাগত চাপ সামলাতে তাঁরা কোন বন্ধু বা গুরুজনের কাছে সাহায্য চাওয়ার বদলে নেশার বোতল তথা ফেসবুক টাইপের জিনিষপাতি খুলে বসে। আর এ-তো জানা কথাই, নেশা কখনই দীর্ঘমেয়াদে ভাল কিছু করতে পারে না; এটা জীবন ধ্বংসকারী একটা বস্তু।
আর এই আসক্তির কারণে দেখা যায়, এই প্রজন্মের বড় একটা অংশ সত্যিকারের বন্ধুত্ব, গভীর সম্পর্কের অর্থই বোঝে না। তাদের বন্ধুত্বগুলো ভাসা ভাসা; যে বন্ধুর উপর নির্ভর করা যায় না – আর এমনও হতে পারে যে মজা শেষে তাকে খুব সহজেই আনফ্রেন্ড করে দিতে পারে। বাস্তব জীবনে ঝগড়া, মারামারি, মান অভিমানে যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা সেরকম গভীর বন্ধুত্ব হওয়ার মত সুযোগই তাদের হয়না। বন্ধু তৈরীর যে পথ, যে কৌশল: সেটা শেখারই কোন সুযোগ তারা পায় না। আর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন চাপ সামলাতে নেশাতে ডুবে যাওয়া ছাড়া তাদের উপায়ও থাকে না।
নেশার যে দ্রব্যগুলো - সেগুলো কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারেই নেশা হয়। বুঝে শুনে সীমিত পরিসরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সেগুলো কিন্তু আনন্দের উৎস হতে পারে। কিন্তু এই সময়ে যেটা হচ্ছে ২৪ ঘন্টাই সেলফোনের প্রভাবে নেশাগ্রস্থ থাকছে একটা প্রজন্ম। আরেকজনের দিকে মাথা তুলে তাকানোর পর্যন্ত সময় নাই। খুব জরুরী দুই একটা কথার বাইরে যে কেমন আছেন, মুরগী ডিম পারছে কি না, কিংবা বাসায় মশার উপদ্রব – বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক তৈরীর শুরুতে জরুরী এই জাতীয় নির্দোষ আলাপচারিতা করার মত সময় বা দক্ষতা তাদের থাকেনা। বন্ধুদের সাথে খেতে বসে যদি সেদিকে মনযোগ না দিয়ে আরেকজনের সাথে ফোনে চ্যাট করতে থাকে কেউ – তাহলে সেটা অবশ্যই একটা নেশা, একটা সিরিয়াস সমস্যা। একটা অফিসিয়াল মিটিংএ যদি মনোযোগটা ফোনের মেসেজে বেশি থাকতে হয়, তাহলে সেটা সমস্যা। ঘুম থেকে উঠে পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের খবর নেয়ার আগে যদি ফোনের মেসেজ চেক করে কেউ – তাহলে সেটা নেশা – অবশ্যই একটা সমস্যা।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যাদের আত্মসম্মানবোধ গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি; আরও দেখা যাচ্ছে চাপ সামলানোর টেকনিকগুলো শেখার সুযোগ আমরা তাদেরকে দেই নাই – নেশাগ্রস্থ হওয়াটা কোন টেকনিক হতে পারে না।
৫।
এবার আসা যাক তৃতীয় কারণে (যেটার সমস্যাটা হল অসহিষ্ণুতা) – তাৎক্ষনিকভাবে চাহিদা মিটে যাওয়ার অভ্যাস। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কেউ কিছু কিনতে চাইলে আয়োজন করে টাকা পয়সা জোগাড় যন্ত্র, হাটের দিন কবে ইত্যাদি খোঁজ নিয়ে সময় করে বাজার/হাটে যেতে হয় না; অনলাইনে তখনি কিনে ফেলতে পারে, টাকা না থাকলে অসুবিধা নাই – কারণ এজন্য ক্রেডিট কার্ড আছে, পেমেন্ট অন ডেলিভারি আছে, ইনস্টলমেন্টের সুবিধা আছে; আর একদিনের মধ্যেই সাধারণত জিনিষটা বাসায় চলে আসে। কেউ সিনেমা দেখতে চাইলে ইউটিউব বা অন্য মিডিয়াতে সাথে সাথে দেখতে পারে, কিংবা পে-চ্যানেলে গিয়েও দেখতে পারে। সিনেমাটা কাছের সিনেমাহলে আছে কি নাই, শো-এর টাইমটেবল, টিকেট আছে কি না – এসব নিয়ে কোন ঝামেলাই নাই। একটা টিভি সিরিজ দেখার ইচ্ছা হলে সাথে সাথেই ইন্টারনেটে সেটা দেখে ফেলা যায়। পরের পর্বের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস অপেক্ষার ফলে সহিষ্ণুতার যে শিক্ষা সেটার কোন বিষয়ই আর নাই এখন। কেউ কেউ তো আবার এতই অধৈর্য যে, মাঝের পর্ব বাদ দিয়ে একেবারে সিজনের শেষ পর্ব দেখে ফেলে।
এমনকি, কাউকে প্রপোজ করাটাও এখন এঁরা শিখতে পারে না। কিভাবে হাত ঘষে ঢোক গিলে বোকা বোকা কথা শুরু করবে ডিজিটাল যুগে এধরণের সামাজিকতা শেখারও প্রয়োজন নাই। ডেটিং সাইটে গিয়ে শুধু ক্লিক করলেই সব ঠিক। এই যুগে যাই চাওয়া হয়, সাথে সাথে পাওয়া যায়, শুধুমাত্র যা পাওয়া যায়না সেটা হল – পেশাদারিত্ব আর গভীর সম্পর্ক। কারণ, এগুলোর জন্য কোন অ্যাপ নাই। এগুলোর অর্জন হয় ধীরগতির, আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথে – যা পেরোতে দরকার ধৈর্য আর একাগ্রতা। কিন্তু এই প্রজন্মের এই অর্জনগুলোর জন্য যে প্রশিক্ষণের দরকার ছিল তা হয়নি। কর্মস্থলে গিয়ে এরা হতাশ হয়, গভীর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয় / পিছিয়ে যায়: কারণ ধৈর্য ধরে সফলতার জন্য অপেক্ষা আর লেগে থাকা, তিল তিল করে সফলতার ভিত্তি গড়ে তোলা বা কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চর্চা - এ ধরণের কোন প্রশিক্ষণই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এরা পায় না। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে চূড়াতে যাওয়ার কামনার মত – এঁরা শুধু চূড়া দেখে আর সরাসরি সিরিয়ালের শেষ পর্ব দেখার মত স্টাইলে সেখানে যেতে চায়। কিন্তু বাস্তব তো এমন নয়: এর জন্য পাহাড় ডিঙানোর পরিশ্রম, ধৈর্য, পরিকল্পনা, দক্ষতা এইসব দরকারী বিষয়গুলোর কোন ধারণাই এদের মধ্যে থাকে না। ফলাফল আরো বেশি হতাশা, হীনমন্যতা।
এইসব কারণে হতে পারে যে সমাজে আত্মহত্যা, মাদকাসক্তির হার বেড়ে যাবে। ডিপ্রেশনের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার হার বেড়ে যাবে। মন্দের ভাল হিসেবে সবচেয়ে ভাল যেটা হতে পারে, তা হল: পুরা সমাজের একটা বড় অংশ রোবটের মত একঘেয়ে একটা জীবন পার করবে কিন্তু কখনই জীবনের আনন্দঘন দিকগুলো সেভাবে উপভোগ করতে পারবে না। কখনই তাদের মধ্যে জীবনবোধের গভীরতা কিংবা পরিপূর্ণতার অনুভূতি আসবে না।
৬।
শেষ বা চতূর্থ পয়েন্টটা হল পরিবেশ। কর্পোরেট কালচারেও সবকিছু স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে করা হয়। এঁরা যে নতুন কর্মী যোগ দিয়েছে তার কোন উন্নয়ন হল কি না সেটা মোটেও ভাবে না বরং নিজেদের স্বল্পমেয়াদী অর্জনের লক্ষ্য ঠিক আছে কি না সেটা নিয়েই চিন্তিত। এটা এমনই একটা পরিবেশ যেটা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে মোটেই সাহায্য করছে না। এই কর্পোরেট পরিবেশ তাদেরকে পারস্পরিক আস্থা, বন্ধুত্ব স্থাপনের যে কৌশল তা শিখতে সাহায্য করছে না। অসহিষ্ণুতা থেকে বেরিয়ে আসতে যে প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং দরকার – ধৈর্যধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যস্থির করে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার – সেটার কোন ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে না এই কর্পোরেট সংস্কৃতি। যে ধরণের অর্জনগুলো করতে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে এক লক্ষ্যে কাজ করতে হয় এবং সেটা অর্জনের পর যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটা অনুভব করার কোন সুযোগই তাদেরকে এখানে দেয়া হয় না। এসব কারণে দিনকে দিন তারা আরও হতাশ হয়ে যায়, মনে করতে থাকে তাঁদের কোন যোগ্যতাই নাই।
বাব-মা’র ভুল, সমাজ-ব্যবস্থার ভুলের ফলে এই প্রজন্ম ক্রমেই আত্মকেন্দ্রীক, অসহিষ্ণু এবং অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে – অথচ তার দায় কেউ নিতে রাজি হয় না। … … … …
৭।
সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনের পরিপ্রেক্ষিতের সাথে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত হয়তো পুরাপুরি মিলবে না। কিন্তু কিছুটা শিক্ষনীয় চিন্তা-জাগানিয়া বিশ্লেষনী দৃষ্টিভঙ্গি যে সেখানে আছে - সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। এই যে আমাদের পোলাপানগুলোকে না চাইতেই গণহারে উচ্চতম জিপিএ দিয়ে পাশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটার দীর্ঘমেয়াদে প্রায় একই রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার কথা। কারণ এতে যাঁরা সত্যিকারের পড়াশোনা করতো তাঁরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তেল আর ঘি’য়ের যখন একই মূল্যায়ন হবে তখন কেন কষ্ট করে ঘি উৎপাদন করবে কেউ? আর এই না চাইতেই পাওয়ার ফলে তাঁদের অবচেতন মনে এমন ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে যে এই ডিগ্রীগুলো ছেলের হাতের মোয়া, সহজলভ্য বস্তু - যা না চাইতেই পাওয়া যায়। এর জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায় এসবের কোন প্রয়োজন নাই। শুধু আসবো যাবো, ফূর্তি করবো, ফেসবুকিং করবো, চকচকে ক্যাম্পাসে ফ্যাশন করে ছবি তুলবো – কয়দিন পর প্রসেসের কারণে ডিগ্রী এমনিই পাওয়া যাবে।
জানি, উচ্চশিক্ষার কিছু জায়গায় এই চর্চাটাই চলছে। কিন্তু অবচেতন মনে হীনমন্যতা ঢুকে আত্মসম্মানবোধহীন যে প্রজন্ম আমরা তৈরী করছি তাতে করে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। কর্মক্ষেত্রে এঁদের বড় অংশ শুধু খাবি খাবে। কোত্থাও টিকতে পারবে কি না জানিনা, তবে হতাশা বাড়তেই থাকবে।
==
ইউটিউবে সাইমন ভাইয়ের ভিডিও লিংক
0 Comments