স্টার্টআপ বললে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গুগল, ফেসবুক, উবার, লিংকডইন, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, আলিবাবা এয়ার-বিএনবির কথা। শূন্য থেকে যারা ছয়, সাত বা দশ, বারো বছরে বিশাল মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীকে নাড়াচাড়া দিয়েছে। স্টার্টআপ কি? কেউ একজন মুদি দোকান বা ভাতের হোটেল খুলল, সেটা কি স্টার্টআপ? অবশ্যই নয়। কারণ সব স্টার্টআপই ব্যবসা হলেও সব ব্যবসাই স্টার্টআপ নয়। স্টার্টআপের সঙ্গে দ্রুত বর্ধনশীলতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোনো উদ্যোগ যদি ‘বিশাল’ না হতে পারে, তবে সেটিকে স্টার্টআপ অভিহিত করা যায় না। অধিকাংশ স্টার্টআপ আমরা দেখতে পাই ‘টেক’ বা প্রযুক্তিনির্ভর। আসলে দ্রুত বর্ধনের জন্য প্রযুক্তি একটি সহজ সোপান।
স্টার্টআপরা নীরবে আমাদের কাজকর্ম বা জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে। আমাদের আচার ব্যবহারে পরিবর্তন এনেছে। কোনো কিছু জানতে হলে রেফারেন্স বইয়ের সুলুক সন্ধানের বদলে আমরা ‘গুগল’ করি। সংবাদ এখন একমুখী নয় — দ্বিমুখী। আমজনতা আর নিছক সংবাদগ্রহীতা নয় — ফেসবুকের কল্যাণে সংবাদদাতাও। নিজস্ব সংবাদ আপন গণ্ডিতে প্রকাশ করতে পারে। ‘ভাবনা প্রকাশ’ আর শুধু বুদ্ধিজীবী বা কেউকেটার আওতাধীন নয় — ‘আমি’ও পারি। শারীরিকভাবে নিজের সুবিধামতো অবস্থানে থেকে স্কাইপির মাধ্যমে এখন ভার্চুয়াল সভা চলে। পাসপোর্ট ভিসার ধার না ধেরে কাজ আর কর্মীর মিলন ঘটছে ‘আপওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা প্রচুর বিত্তের মালিক হয়েছেন। সেটা নিয়ে অর্থাত্ কোন কোম্পানি কত বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়েছে, তা নিয়ে বেশি মাতামাতি হচ্ছে। গাঁটের পয়সা কেউ তো আর এমনি এমনি দেয় না। বিপুল লোকের জন্য উপযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে বলেই তো মানুষ জেব উপুড় করে রেস্ত দিচ্ছে। দয়া-দাক্ষিণ্য করে নিশ্চয় নয়।
স্টার্টআপ নিয়ে আমাদের দেশেও বহুত বাতচিত, হইহট্টগোল হচ্ছে। হ্যাকাথন হচ্ছে। সরকার ‘কানেক্টিং স্টার্টআপ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। স্টার্টআপের জন্য ইনকিউবেটর খুলেছে। পরিত্যক্ত জনতা টাওয়ারকে মেরামত করে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে। স্টার্টআপদের কো-ওয়ার্কিং প্লেস হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কেউ যখন ব্যবসা শুরু করে, তখন অফিসের জন্য জায়গা বা একটা ঠিকানা পাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারা চায় একটা ভালো এলাকায় অফিসের জন্য জায়গা পেতে। কিন্তু ভাড়ার কথা চিন্তা করে সম্ভব হয় না। তারা নেম কার্ডে এখন ঠিকানা ‘কাওরান বাজার’ লিখতে পারছে।
কম্পাস.কম বিশ্বের ৪০টি শহরের ওপর সার্ভে চালিয়ে ‘বিশ্ব স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম রিপোর্ট ২০১৫’ প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ ইকো সিস্টেম (কর্মপরিবেশ) সর্বোত্তম। স্টোরিফাইর প্রধান নির্বাহী যেভিয়ার দাম্মান বলেছেন, ‘সিলিকন ভ্যালিকে যা অন্য শহর থেকে আলাদা করেছে তা হলো, এখানে কেউ কোনো আইডিয়াকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না’। এশিয়ার মধ্যে তেলআবিব স্টার্টআপ-অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে সেরা। যদিও সারা বিশ্বের মধ্যে তা পঞ্চম। প্রথম চারটি স্থান যুক্তরাষ্ট্রের চারটি শহর দখল করে আছে। সিলিকন ভ্যালি, নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও বোস্টন। সিঙ্গাপুরের স্থান দশম আর ভারতের বেঙ্গালুরুর পঞ্চদশ। অবশ্য চীন, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার শহরগুলো এই সার্ভেতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০১২ সাল থেকে কম্পাস.কম ‘বৈশ্বিক স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে আসছে। স্টার্টআপের জন্য কোন কর্মপরিবেশ বা ইকোসিস্টেম উত্তম — তা মূল্যায়নের জন্য পাঁচটি মাপকাঠি বেছে নেয়া হয়েছে — ১. স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের দক্ষতা ২. অর্থায়ন, ৩. প্রতিভাবান মানবসম্পদের সংযোগ, ৪. বাজারের সীমানা, ৫. স্টার্টআপ অভিজ্ঞতা।
ইকোসিস্টেমের দক্ষতার বিচারকগুলো: ১. ইকোসিস্টেমের আকার বা মূল্য ২. স্টার্টআপদের আউটপুটের মূল্য ৩. বর্ধনের হার। সিলিকন ভ্যালির ইকো সিস্টেমের আকার ২৬৪ থেকে ৩২৩ বিলিয়ন ডলার। সব স্টার্টআপের এক্সিট ভ্যালু (বা ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল তাদের শেয়ার বিক্রয়কালীন মূল্য) যোগ করে ইকোসিস্টেমের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে ১২ থেকে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সিলিকন ভ্যালির আউটপুট ১৪ থেকে ১৯ হাজার, বেঙ্গালুরুতে যা ৩ থেকে ৫ হাজার ডলার। সিলিকন ভ্যালির বর্ধনের হার ২ দশমিক ১, বেঙ্গালুরুর যা ৪ দশমিক ৯।
একটি শহরের স্টার্টআপে কত টাকার ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল অর্থ বিনিয়োজিত হয়েছে এবং এক্সিট বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি কত টাকায় তাদের শেয়ার বিক্রি করেছে, তার পরিমাণ দিয়ে ওই ইকোসিস্টেমের অর্থায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। বিনিয়োগের ওপর ৮০ শতাংশ ও এক্সিটের ওপর ২০ শতাংশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সারা পৃথিবীর পুরো ভেঞ্চার বিনিয়োগ ও এক্সিটের ৪৫ শতাংশ ঘটেছে সিলিকন ভ্যালিতে, তাই অর্থায়নের বিচারে তারা প্রথম। সিলিকন ভ্যালিতে সিড রাউন্ড বা আইডিয়া পর্যায়ে ৯ বা সাড়ে ৯ লাখ ডলার পাওয়া যায়। সিরিজ এ বা ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ লাখ ডলার পাওয়া যায়, যার বিনিময়ে গড়ে ১৯ শতাংশ শেয়ার দিতে হয়। বিনিয়োগকারীদের ৬১ শতাংশ স্থানীয়। সিঙ্গাপুরে একটা স্টার্টআপ সিড রাউন্ডে গড়ে ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ পায়। সিরিজ এ রাউন্ডে পায় ৪০-৪৫ লাখ ডলার, বিনিময়ে গড়ে ২২ শতাংশ শেয়ার দিতে হয়। ৬৭ শতাংশ বিনিয়োগকারী স্থানীয়। বেঙ্গালুরুতে সিড রাউন্ডে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ ডলার পাওয়া যায়। সিরিজ এ রাউন্ডে ৪০-৪৫ লাখ ডলারের বিনিময়ে ১৮ শতাংশ শেয়ার পাওয়া যায়। অর্থাত্ কোম্পানির মূল্য ২ থেকে ২ দশমিক ৫ কোটি ডলার বা ১৫০-২০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীদের ৫৭ শতাংশ স্থানীয়।
প্রতিভাবান মানবসম্পদ সংযোগের মাপকাঠিগুলো প্রকৌশলী নিয়োগের সময়কাল, সফটওয়্যার প্রকৌশলীর বেতন, রিমোট বা দূর অবস্থানকারী কর্মী, মহিলা কর্মী ও বিদেশী কর্মী। বেঙ্গালুরুতে প্রকৌশলী নিয়োগে ৩৯ দিন সময় লাগে সিলিকন ভ্যালিতে, যা লাগে ৪০ দিন। সফটওয়্যার প্রকৌশলীর বার্ষিক বেতন সিলিকন ভ্যালিতে ১১৮ হাজার ডলার বেঙ্গালুরুতে যা ২৩ দশমিক ৫ হাজার ডলার। বেঙ্গালুরুতে ১৬ শতাংশ দূর অবস্থানকারী, ১৮ শতাংশ মহিলা ও ২ শতাংশ বিদেশী কর্মী আছে সিলিকন ভ্যালিতে, যা যথাক্রমে ৪৩, ২৯ ও ৪৫ শতাংশ।
বাজার প্রসারের মাপকাঠিগুলো ওই ইকোসিস্টেমের বিদেশী ক্রেতা, বিদেশী পণ্য-ভাষার সংখ্যা, ওই শহরের জিডিপি। সিলিকন ভ্যালিতে যাদের প্রধান কার্যালয়, সেসব স্টার্টআপের বিদেশে বিক্রি বা রফতানির হার ৩৬ শতাংশ বেঙ্গালুরুতে ৩৩ শতাংশ (রফতানির ধারণাও পাল্টে যাচ্ছে। অ্যামাজনের মাধ্যমে যেকোনো দেশ থেকে পণ্য কেনা যায়। প্রচলিত আমদানি-রফতানির বিধিবিধান পাল্টে যাচ্ছে)। সিলিকন ভ্যালির বিদেশী পণ্য-ভাষার সংখ্যা ২ দশমিক ২, বেঙ্গালুরুতে যা ১ দশমিক ৬। সিলিকন ভ্যালির মেট্রোপলিটন জিডিপি ৫৩৫ বিলিয়ন আর বেঙ্গালুরুতে ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
স্টার্টআপ অভিজ্ঞতা বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠাতার বয়স, বর্ধিষ্ণু স্টার্টআপে তাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা, স্টার্টআপের ঘনত্ব, উদ্যোক্তাদের মধ্যে কতজন ‘টেকি’, তা বিবেচনা করা হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠাতার গড় বয়স ২৮ দশমিক ৫, সিলিকন ভ্যালিতে যা ৩৬ দশমিক ২ বছর। বেঙ্গালুরুতে ১৪ শতাংশ ও সিলিকন ভ্যালিতে ৩৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠাতার অন্য স্টার্টআপে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বেঙ্গালুরুতে স্টার্টআপ ঘনত্ব ৩ দশমিক ৫ থেকে ৬ (অর্থাত্ প্রতি এক হাজারে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৬টি স্টার্টআপ আছে) ভ্যালিতে ১ দশমিক ৮ থেকে ২। সিলিকন ভ্যালিতে ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন টেক উদ্যোক্তা আছে, বেঙ্গালুরুতে যা ৯৬ শতাংশ।
বিশ্ব স্টার্টআপ ম্যাপে ঢাকার নাম নেই। ব্যাপারটা আমাদের জন্য দুঃখের হলেও এটি কঠিন বাস্তবতা। স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম হিসেবে গণ্য হতে হলে বেশকিছু কাজ করা দরকার। আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে স্টার্টআপবান্ধব করতে হবে। ১. ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে ম্যাচিং ফান্ড ও সরাসরি স্টার্টআপকে অর্থায়ন করে এটি করা যায়। তেলআবিব, সিঙ্গাপুর, সান্টিয়াগো এ কৌশল প্রয়োগ করে, বিশেষ করে ইকোসিস্টেমের প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো সুফল পেয়েছে। ২. বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মেধা দেশে আসার পথ সুগম ও ঝামেলাবিহীন করা। ৩. স্টার্টআপের জন্য নিয়মনীতি শিথিল করতে হবে, যাতে তাদের নিবন্ধন, দেউলিয়া, শেয়ার হস্তান্তর, এক্সিট ও কোম্পানি বন্ধ করা সহজ ও সাবলীল হয়। ৪. ইকোসিস্টেমটির অনন্যতা চিহ্নিত করা। এটি সেক্টরভিত্তিক বা স্টার্টআপের বয়সভিত্তিক হতে পারে। যেমন লস অ্যাঞ্জেলস মিডিয়ার জন্য বোস্টন জীবন্ত বিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত। ৫. বিভিন্ন আইন-কানুন বা পলিসি স্টার্টবান্ধব করে সাজাতে হবে। সবকিছু দেখতে হবে ‘স্টার্টআপ চক্ষু দিয়ে’। ৬. নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতিভার ওপর বাজি ধরার মতো বড় কলিজার বিনিয়োগকারী, যারা একটা আইডিয়ার ১০-১৫ কোটি টাকা বা একটি পণ্য পরীক্ষা পর্যায়ের কোম্পানিকে ১০০-১৫০ কোটি টাকা মূল্যায়ন করতে পারবে।
ঢাকা কি পারবে নিজের পদচিহ্ন বিশ্ব স্টার্টআপ ম্যাপে ফুটিয়ে তুলতে? সহজ নয়। আবার নয় অসম্ভবও। বেঙ্গালুরু পারলে ঢাকা কেন পারবে না? তবে প্রয়োজন সদিচ্ছার। লেগে থাকার। স্টার্টআপে যেমন লেগে থাকতে হয়।
লেখক: শওকত হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিডি ভেঞ্চার লিমিটেড।
( লেখাটি বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় )
0 Comments