যারা মেডিকেলে পড়তে চাও তাদের জন্য এই লেখা

এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন রাত দশটা। ঠিক এক বছর আগে এই দিনে, এই সময়ে আমি কী করছিলাম, মনে করার চেষ্টা করি। হয়তো পরদিনের মডেল টেস্টের পড়া গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। হয়তো বিগত বছরের কোনো প্রশ্নপত্র সমাধান করছিলাম। কিংবা পড়ার টেবিলে বসে হয়তো আজকের এই দিনটির স্বপ্নই দেখছিলাম!
মা-বাবার চাকরির কারণে আমাকে ছোটবেলায় অনেকবার স্কুল বদল করতে হয়েছে। তখন ভাবতাম, বড় হয়ে প্রকৌশলী হব। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলাম খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে। কলেজে পড়ার সময় কীভাবে যেন জীবনের লক্ষ্যটা বদলে গেল। আমার একমাত্র ছোট ভাইটা অটিজমে আক্রান্ত। ওর মতো আরও যারা আছে, তাদের জন্য একটা কিছু করার তাড়না আমার ভেতর কাজ করছিল। তাই ঠিক করে ফেললাম, আমি চিকিৎসক হব।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, কিংবা নিরাশা—কোনোটাই কখনো আমার ওপর ভর করেনি। আমি শুধু আমার কাজটা করে গেছি। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করেছি। অল্প পড়েছি, কিন্তু মন দিয়ে পড়েছি। অনেকে বলে, মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেলে দিনরাত এক করে পড়তে হয়। আমার বেলায় কিন্তু ব্যাপারটা এমন ছিল না। সব সময় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছি, আবার সকালবেলা উঠে পড়তে বসেছি। আমার কাছে মনে হয়, ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমটাও খুব জরুরি। দুপুর পর্যন্ত কোচিং করেই কাটত। বিকেলে কখনো পড়তাম না। মা-বাবার সঙ্গে গল্প করতাম, কিংবা অন্য কিছু করতাম। এই সময়টা আমার অবসরের জন্য রাখা ছিল।
এখন মেডিকেলের পড়ার চাপে অবসর তেমন পাই না। পড়ার চাপ খুব বেড়ে গেলে মনে হয়, বাসায় যেত পারলে ভালো লাগত। এখানে ভর্তি হওয়ার আগে কখনো মা-বাবাকে ছেড়ে থাকিনি। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছি, প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি—এটাই আনন্দ।
লেখকের দশ পরামর্শ
১. পাঠ্যবই পড়তেই হবে
মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার নিয়মকানুনগুলো তো তোমাদের জানা। জীববিজ্ঞানে ৩০, রসায়নে ২৫, পদার্থবিজ্ঞানে ২০, ইংরেজির জন্য ১৫, আর সাধারণ জ্ঞানে ১০০ নম্বর থাকে। জীববিজ্ঞান, রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, পাঠ্যবইটি খুব ভালো করে পড়তে হবে। তাহলে জানতে পারব, আমার দুর্বলতা কোথায়। কোন অংশটা আমি ভালো জানি। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবইগুলো পুরোটা আয়ত্তে থাকতে হবে।
২. অনুশীলন আর অনুশীলন
যত বেশি সম্ভব, মডেল টেস্ট দিতে হবে। কোচিংয়ে পরীক্ষা দিতে পারো। বাড়িতে বসেই পুরোনো প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখতে পারো। যত বেশি পরীক্ষা দেবে, তত নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারবে। প্রস্তুতি না নিয়ে কোনো পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আবার অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে যদি প্রস্তুতি নিতে না-ই পারো, তবু কোনো মডেল টেস্ট দেওয়ার সুযোগ ছাড়া যাবে না।
৩. সাম্প্রতিক খবর
সাধারণ জ্ঞানের জন্য পরীক্ষার আগের তিন মাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো জেনে রাখা দরকার। কোনো অর্জন, কোনো বিখ্যাত মানুষের মৃত্যু, খেলাধুলায় কোনো বড় রেকর্ড—এ রকম কোনো কিছুই বাদ দেওয়া যাবে না। সাধারণ জ্ঞান বা ইংরেজির জন্য যেহেতু সেভাবে কোনো সিলেবাস ধরাবাঁধা নেই, তাই এ দুটি বিষয়ে একটু জোর দিতে হবে।
৪. পরীক্ষার আগের ১ মাস
পরীক্ষার আগের এক মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এই সময়ে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ থাকে। কোচিংয়ের চাপ থাকে না বলে অনেকে এই সময়ে একটু ঢিল দিয়ে ফেলে। ভাবে, প্রস্তুতি যা নেওয়ার, তা তো নিয়েছিই। এটা একটা বড় ভুল। এই সময়টাতেই আরও বেশি করে প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫. একেকজনের একেক কৌশল
তুমি কোন বিষয়ে ভালো আর কোথায় তোমার দুর্বলতা, সেটা তো তুমিই সবচেয়ে ভালো জানো। একেকজনের পড়ার কৌশল একেক রকম। তাই তোমার পড়ার ধরনের সঙ্গে মেলে, এমনভাবেই কোনো পরিকল্পনা করা উচিত। কেউ একবার পড়লেই মনে থাকে, কারও একই জিনিস বারবার অনুশীলন করতে হয়। যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ কর, সেভাবেই একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে নাও।
৬. সবার পরামর্শ শুনতে হবে না
ভর্তি পরীক্ষা সামনে বলে নিশ্চয়ই অনেকে তোমাকে অনেক রকম পরামর্শ দেবে। সবার পরামর্শ আমলে নিতে হবে তা নয়। বিশেষ করা যারা তোমাকে নিরুৎসাহিত করবে, বলবে তোমাকে দিয়ে হবে না—এসব কথা কানে নিয়ো না। তুমি তোমার কাজ করে যাও। তবে যেসব বড় ভাই-আপুরা মেডিকেলে পড়ছেন, যাঁদের এই পরীক্ষার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে পারো।
৭. সময় অনেক দামি
পরীক্ষার সময় প্রতিটি মুহূর্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রশ্নের উত্তর করার বাইরে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে তোমাকে যেন আর কিছু বিরক্ত না করে, সেদিকে খেয়াল রেখো। হলে বসে তোমার চেয়ার বা টেবিলটা ভাঙা কি না, সব ঠিকঠাক আছে কি না, আগেই দেখে নাও। একবার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে এসব নিয়ে ভাবার সময় আর থাকবে না। যেসব প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত, সেগুলো আগে উত্তর করে ফেলা ভালো। এক ঘণ্টার পরীক্ষা। সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে ফেলতে আমার সময় লেগেছিল ৪৭ মিনিট। বাকি সময়ের মধ্যে একটু দ্বিধা থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। পরীক্ষায় আমি ৮৭ নম্বর পেয়েছিলাম।
৮. সুস্থ থাকতে হবে
প্রস্তুতির দিকে বেশি জোর দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে চলবে না। এখন যেহেতু ডেঙ্গুর খুব প্রকোপ, এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। জ্বরে পড়ে তিন দিন নষ্ট হলে সেটাও বড় ক্ষতি। আমি যেমন অল্প করে হলেও প্রতিদিন পড়েছি, এক দিনও বাদ দিইনি।
৯. আত্মবিশ্বাস রেখো
মেডিকেলের এই ভর্তি পরীক্ষা অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো। আত্মবিশ্বাস তোমার মধ্যে থাকতেই হবে। আগেই যদি মনে হয়, ‘আমাকে দিয়ে হবে না’, তাহলে পরীক্ষার হলেও তুমি ঘাবড়ে যাবে। বারবার অনুশীলন করার মধ্য দিয়ে এ আত্মবিশ্বাস তৈরি করা যায়। হাল ছেড়ে দিয়ো না।
১০. কোনো ফাঁদে পা দিয়ো না
কেউ যদি বলে, পরীক্ষার আগের রাতে তোমাকে প্রশ্ন দেবে, তার থেকে ১০০০ হাত দূরে থেকো। গত কয়েক বছর মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগও নেই। পরীক্ষার আগের রাতে যদি বন্ধুরা বলাবলি শুরু করে, অমুক জায়গায় প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে, ভুলেও ওসব কথায় কান দিয়ো না। তুমি তোমার লক্ষ্যে অবিচল থেকো।
লেখক: ইশমাম সাকিব, ঢাকা মেডিকেল কলেজের

Post a Comment

0 Comments