বাংলাদেশের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির
গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম টেলিভিশন। স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের বিনোদন ক্ষেত্রে
এটি একটি পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। উš§ুক্ত করেছে বিস্ময়কর ও অপার
সম্ভাবনার।
দেশে বর্তমানে ৪০টিরও বেশি টেলিভিশন
চ্যানেল মূলত বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে
মাত্রাজ্ঞানহীন বিজ্ঞাপনের স্বেচ্ছাচারী প্রচারণা এই শিল্পের তথা সমাজের
জন্য কি অমোঘ বিপর্যয় বয়ে আনছে তা দেখার যেন আদৌ কেউ আছে বলে মনে হয় না।
কেননা আধঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে কতক্ষণ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তাতে
বিনোদনের উপযোগিতা-সুস্থতা কতটা বজায় থাকে তা নিরুপায় দর্শক মাত্রই সম্যক
অবহিত। তাই বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য অনুষ্ঠানের (অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপন
প্রচার, কথাটা বলতে পারলাম না কিছুতেই) গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে
দিনের পর দিন।
সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, খবর,
টকশোসহ যে কোনো অনুষ্ঠান এমনকি পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে প্রচারিত কোরান
তেলাওয়াতের অনুষ্ঠানেও সিøভলেস জামা পরিহিতা, উজ্জ্বলতম লিপস্টিকে রাঙানো
ঠোঁটের মডেলদের বিজ্ঞাপন যেন সারাদিনমান তো বটেই এমনকি ইফতারের সময় সমবেত
পরিবারের ছোট বড় সবাই কাক্সিক্ষত মুহূর্তের জন্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ
পরিবেশে যখন ইবাদতে মশগুল, তখনও এ জাতীয় বিজ্ঞাপন আমাদের গিলে হজম করে যেতে
হয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বিব্রতকর, বিরক্তিকর,
সর্বোপরি লজ্জাজনক হলো- স্থানীয় কেবল অপারেটরদের সিডি/এন্টারটেনমেন্ট
চ্যানেলগুলোতে অর্থলিপ্সু, অসুস্থ মানসিকতার কিছু কুরুচিপূর্ণ নামসর্বস্ব
কোম্পানির অনৈতিক বিজ্ঞাপনের সদর্প প্রদর্শন, যা আমাদের কৃষ্টির পরিপন্থী-
একইসঙ্গে অবক্ষয়ের পরিচায়ক। এর কোনটি কালো মানুষের গায়ের রং ফর্সা করার,
মোটাকে চিকন এবং চিকনকে মোটা মানুষে পরিণত করার, ডায়াবেটিস নির্মূল করার,
টাকে চুল গজানোর, কোনটি আবার যৌন দুর্বলতা দূর করার মতো স্পর্শকাতর বিষয়কও
বটে।
মানুষের গায়ের কালো রং মাত্র ৭ দিন
ব্যবহারে উজ্জ্বল/ফর্সা রঙে পরিণত করতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার মহান সৃষ্টি
আশরাফুল মাখলুকাত- মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত গাত্রবর্ণ নিয়ে যে কটাক্ষ,
ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করা হয় তা যেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মহিমাকে ব্যঙ্গ করারই
শামিল। ফেয়ারলুক নামক রং ফর্সাকারী এই ক্রিম ব্যবহারের আগে- কালো
গাত্রবর্ণের মানুষকে কত রকমের অসুবিধায় পড়তে হয়- আবার ব্যবহারের পর- কত
রকমের ফ্যাসিলিটিজের মধ্যে মানুষ চলে আসতে পারে তার সচিত্র উপাখ্যান। যার
মূল্য- ২৪৯০/- কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রচারকালীন টিভি স্ক্রিনে দেখানো নম্বরে
অর্ডার করা হলে মূল্য রাখা হয় ১৫৯০/- টাকা, ডেলিভারি চার্জ আলাদা।
এরপর আছে মোটাকে চিকন করার এবং চিকন
মানুষকে মোটা মানুষে রূপান্তর করার জাদুকরি মহৌষধ বডিবিল্ড-এর বিজ্ঞাপন। যা
ব্যবহারে ফোলানো বেলুনের বাতাস হঠাৎ বের করে চুপসে দেওয়ার মতো অতি অল্প
সময়ের মধ্যে বিনা ক্লেশে মোটা মানুষের শরীরের মেদ ঝরিয়ে দেয়া হয়। একই
রকমভাবে চিকন মানুষকে মোটা করার জাদু তুলে ধরা হয়। যার মূল্য ৫২০০/-
বিজ্ঞাপন চলাকালীন স্ক্রিনে দেখানো নম্বরে কল করে অর্ডার করা হলে বিশেষ
রেয়াতে মূল্য ৩২০০/- টাকা ডেলিভারি চার্জ আলাদা। ফোন উঠান কল করুন ।
ভিপি/কুরিয়ার যোগে ওষুধ পাঠানো হয়। নকল এড়াতে স্ক্রিনে দেখানো পণ্যের সাথে
প্রাপ্ত ওষুধ মিলিয়ে নিন- স্টক সীমিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে অবাক করা বিজ্ঞাপন হলো
ডায়াবেটিস নির্মূলের বিজ্ঞাপন। ডায়াবেটিস আমাদের শরীরের প্যাংক্রিয়াস বা
অগ্নাশয়ে অবস্থিত বিটাসেল নামক গ্রন্থির কর্মক্ষমতা হ্রাস করে ইনসুলিন
তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইনসুলিন খাদ্যের গ্লুকোজকে বিপাকের
মাধ্যমে শরীরে শক্তি উৎপাদন/ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কার্যকর
ভূমিকা পালন করে থাকে। আর তাই ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন তৈরি হয় না/ কম হয়।
ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচার ব্যাহত হয়।
ক্রমান্বয়ে হার্ট, কিডনি, চোখ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমে
যেতে থাকে। কায়িক শ্রমবিমুখ, ভোজনবিলাসি ও অতি দুশ্চিন্তা পরায়ণ মানুষের
মধ্যে সাধারণত এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়- যা অধুনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায়
আমরা উদ্বিগ্ন। এই রোগ জীবানাচার পরিবর্তন করে হয়তো প্রতিরোধ যোগ্য, একবার
হয়ে গেলে এর মাত্রা নিয়মাচার পরিপালন সাপেক্ষে/নিয়মিত ওষুধ সেবনে হয়তো
নিয়ন্ত্রণযোগ্য- কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে নিরাময়যোগ্য হয়ে ওঠেনি এখন পর্যন্ত।
অথচ ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য বলে
চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রচার করা হয়ে থাকে ‘ডায়াবেটা’ নামক ৫২০০/- মূল্যের
ওষুধের এই বিজ্ঞাপনে। ভিনদেশি চ্যানেলে- যা আমাদের দেশেও প্রচারিত, আরো
একটি বিখ্যাত বিজ্ঞাপন হলো ‘নেশাবন্ধ’ (Stop addiction) নামক যে কোনো নেশা
থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার অপর এক মহৌষধের বিজ্ঞাপন। দৃশ্যক্রম অনুযায়ী
দেখা যায় নারীর আধিক্য সম্পন্ন শত শত লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে এই মহৌষধ
সংগ্রহের দৃশ্য চিত্রায়ন করে খবর হিসেবে প্রচারের জন্য আগত এক টিভি
চ্যানেলের প্রতিনিধি লাইন দিয়ে ‘নেশাবন্ধ ’ (Stop addiction) ওষুধ
সংগ্রহকারীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন- লাইনে দাঁড়িয়েছেন কেন? কেউ বলছে নেশা
করে স্বামী মারধর করে তাই এই ওষুধের উপকারিতা শুনে স্বামীর নেশা ছাড়াতে
ওষুধ সংগ্রহের মানসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এমনিভাবে কেউ সন্তানের, কেউ বাবার,
কেউ ভাইয়ের মরণ নেশা ছাড়ানোর ওষুধ ‘নেশাবন্ধ’ সংগ্রহের জন্য লাইনে
দাঁড়িয়েছেন।
সেই সঙ্গে নেশা করে- কার স্বামী, কার
ছেলে, কার বাবা, কার ভাই পরিবারে কি রকম অশান্তির সৃষ্টি করছে তার
ভিজুয়ালাইজেশন চলতে থাকে। শত শত নিরাময় কেন্দ্র যখন নেশাগ্রস্তদের নেশা
ছাড়ানো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যখন প্রায় ব্যর্থতায়
পর্যবসিত হয়েছে তখন সর্বমোট ৬০ দিনের কোর্সে ১৬ প্রকার জড়িবুটি দিয়ে তৈরি
করা ১৫০০০/- টাকা মূল্যের এই মহৌষধের বিজ্ঞাপন ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।
এরপরে আছে ‘অব্যর্থ টার্গেটেড’ যৌন দুর্বলতার সমস্যা নিয়ে প্রচারিত একাধিক
বিজ্ঞাপন। এই রোগের জন্য ওষুধও অনেক এবং ঐতিহাসিক নামসহ হাল আমলের সিনেমার
নামে এদের বাহারি নাম এবং দাম। যেমন মুঘল প্রাস মূল্য- ৫৫০০/-, মহাবলি
তুফান জোস মূল্য ৫০০০/-, শক্তি পাওয়ার প্রাস মূল্য ৩১০০/-, ভিগা স্প্রে
মূল্য ২৫০০/-, ইরোজ ক্রিম মূল্য ২৬০০/-, স্টে-অন মূল্য ৫৫০০/- টাকা ইত্যাদি
ইত্যাদি।
এখানেও লক্ষণীয় মজার বিষয় হলো- একই ওষুধ
নারী পুরুষ উভয়ের জন্য। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের শরীরের এই হরমোন পৃথক
প্রকৃতির হলেও অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রসূত আপত্তিকর দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজে
স্পর্শকাতর এই বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চলছেই। সারাদিনমান ধরে টেলিভিশনে এই
বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এদের প্রচারণার কোনো রাখঢাক নেই। যখন খুশি
প্রচার করা হচ্ছে দেশের শিশুকিশোরদের কথা না ভেবেই। আর এই সমস্ত
প্রতারণামূলক ওষুধের প্রচারণা পারিবারিক তথা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যেন
চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের হীনম্মন্যতাকে প্রকট করে তুলছে।
সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে- আলোচিত
ওষুধ এবং তার বিজ্ঞাপনগুলো অন্যদেশের। আর আমদানিকারক/সরবরাহকারী হিসেবে
একটি বিশেষ কোম্পানির নাম, গোটা বিশেক মোবাইল নম্বর, গোটা পাঁচেক ই-মেইল
এড্রেস দেখা যাচ্ছে সব ওষুধের বেলাতেই। কিন্তু কোম্পানির অফিসের কোনো
ঠিকানা দেখানো হয় না। বিষয়টি কতখানি যৌক্তিক? অথচ আমদানি করা অন্য সব
পণ্যের ক্ষেত্রেই আমদানিকারকের নাম ঠিকানা আমরা দেখতে পাই। মাঝে মাঝে মনে
হয় সিডি চ্যানেল ও বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত কুরুচিপূর্ণ
বিজ্ঞাপনের যেন নির্লজ্জ আগ্রাসন চলছে আমাদের সমাজে। লজ্জার বিষয় যে,
বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা অজয় দেবগন, গোবিন্দ ও সনি ৮ চ্যানেলে প্রচারিত
‘সিআইডি’ ধারাবাহিকে গোয়েন্দা পুলিশের এসিপি প্রদ্যুমান চরিত্রে রূপদানকারী
শিবাজি শতম প্রমুখ অভিনেতারাও এই সমস্ত বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন। যেহেতু
প্রিয় অভিনেতা, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, সাহিত্যিক- এদের মোহময়তায় সাধারণ মানুষ
আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তাই বিজ্ঞাপনের পণ্য যাই হোক না কেন মোহাচ্ছন্ন মানুষ তা
গ্রহণ করে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, মানুষ যখন বিনা ক্লেশে আশাতীত সাফল্য অর্জন
করে তখন অনেকেই এ রকম বেপরোয়া অর্থলোভী হয়ে ওঠে এবং পরিণতি না ভেবে শুধু
আর্থিক দিক বিবেচনা করে এই সমস্ত অবক্ষয়ের অনৈতিক অংশীদারে পরিণত হয়।
যেহেতু প্রতিটি পণ্যেরই বিজ্ঞাপনে দেখানো
মোবাইল নম্বরে অর্ডার করতে বলা হয় এবং অর্ডারকৃত ওষুধ ভিপি/কুরিয়ার যোগে
পাঠানো হয় সেহেতু ব্যাপারটা আরো রহস্যজনক। আমরা কী তাহলে হায় হায় কোম্পানির
খপ্পরে পড়েছি? দেশের কোনো কর্তৃপক্ষের কাছেই কি এদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?
সর্বোপরি নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক সন্ত্রাস এবং সু-কৌশল প্রতারণা দেখার
মতো কি আমাদের কেউ নেই? - লেখক: সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা
0 Comments