তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে কম পুঁজি নিয়ে শুরু করা স্টার্টআপগুলোও হাজার কোটি টাকার কম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। একটি স্টার্টআপ শুরু করার সময় বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। বিষয়গুলো কী—জানাচ্ছেন নাদিম মজিদ
একটি দেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন অনিক হাসান। সকাল ৯টায় অফিসে হাজির হতে হয়। গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রায় সময়ই বিরক্ত হতেন তিনি। অনেক সময় বাসে উঠে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে যেতে হতো। একদিন কিনে নেন পছন্দের মোটরসাইকেল। অফিসে যাতায়াত করা নিয়ে আর তেমন সমস্যা হয় না। অফিসে যাওয়ার সময় দেখতেন, অনেকে রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। অপরিচিত হওয়া এবং গন্তব্য একই রাস্তায় কি না তা জানার সুযোগ না থাকায় তাদেরকে চাইলেও লিফট দেওয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং স্টার্টআপগুলো চালু হওয়ার পরে বদলে গেছে দৃশ্যপট। এখন অফিসে যাওয়ার সময় অনিক যেমন কাউকে নিয়ে যেতে পারেন, ফেরার পথেও নিয়ে আসতে সমস্যা হয় না। কারণ রাইডার এবং যাত্রী উভয়ের তথ্য থাকছে অ্যাপে। ফলে নিরাপত্তা এবং গন্তব্য জানা নিয়েও সমস্যা হয় না। এতে অফিসে আসা-যাওয়ার সময় যেমন অনিকের আয় হচ্ছে, অন্য যাত্রীদেরও গন্তব্যে পৌঁছাতে সুবিধা হচ্ছে। নিরাপত্তা, সামাজিক সমস্যার সমাধান প্রভৃতি যুক্ত থাকায় এভাবে দিন দিন পাঠাও, ওভাই, উবারের মতো স্টার্টআপগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
প্রথমেই চাই আইডিয়া
যেকোনো স্টার্টআপ শুরু করার জন্য আইডিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার স্টার্টআপের আইডিয়াটি মানুষের কাজে না লাগলে সেই স্টার্টআপটি বিকশিত হবে না। আইডিয়া বাছাই করার সময় খেয়াল রাখবেন, আপনার চারপাশে কী কী সমস্যা রয়েছে এবং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার সমাধান করা যায় কি না? যেমন—আপনি একটি আবাসিক এলাকায় থাকেন। সেখানে খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্ট বেশ দূরে। যেতে-আসতে যেমন সময় যায়, ব্যয় হয় অর্থও। ভালো-মন্দ কিছু খেতে চাইলে দূরত্বই বাগড়া দিয়ে থাকে প্রথমে। খবর নিয়ে দেখুন, আপনার আশপাশে থাকা অন্যরাও একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কি না। এ সমস্যার সমাধান চাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলে আপনি সে এলাকায় চালু করে দিতে পারেন খাবার পৌঁছে দেওয়ার এক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান। এভাবে যেকোনো স্টার্টআপ সফল করার জন্য আপনার আশপাশের সমস্যাগুলো থেকে আইডিয়া নিন।
স্টার্টআপের চার দক্ষতা
যেকোনো স্টার্টআপ পরিচালনা করার জন্য চার ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়। বিক্রয়, বিপণন, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অপারেশন। এসবের মধ্যে যেকোনোটি দুর্বল হলে স্টার্টআপের অগ্রযাত্রা দুর্বল হয়ে থাকে। আপনার স্টার্টআপে কী ধরনের জনশক্তির ঘাটতি আছে, তা নির্ণয় করুন এবং সেভাবে কর্মী নিয়োগ দিন। যেকোনো কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখুন, আপনার স্টার্টআপের যে লক্ষ্য, তা পূরণে তারও যেন আগ্রহ থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনি ফ্রিল্যান্সার বা এজেন্সি নিয়োগ দিতে পারেন। আপনার স্টার্টআপ ওয়েবভিত্তিক বা অ্যাপভিত্তিক হলে তা তৈরি করার জন্য কোনো সফটওয়্যার ফার্মকে দায়িত্ব দিতে পারেন। আপনার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলে পণ্য ডেলিভারির জন্য খরচ কমাতে কুরিয়ার সার্ভিসের সাহায্য নিতে পারেন।
দল গঠনে মনোযোগ দিন
যেকোনো স্টার্টআপের প্রধান শক্তি টিমওয়ার্ক বা দলগত কর্মপদ্ধতি। প্রতিষ্ঠাতার দক্ষতার পাশাপাশি অন্য সদস্যদের দক্ষতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্টার্টআপ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি ভালো দল গঠন করা জরুরি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল স্টার্টআপের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। কেননা তখন প্রয়োজনের তুলনায় পুঁজি বেশি খরচ হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন জনবল থাকলেই হয় না, এসব জনবলকে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থেরও প্রয়োজন হয়। এ জন্য স্টার্টআপ শুরু করার সময় খরচ যতটা সম্ভব সীমিত রাখা উচিত। স্টার্টআপে প্রয়োজন এমন দক্ষ ব্যক্তি হাতের কাছে থাকলে তাঁকে বেতন না দিয়ে প্রতিষ্ঠানে অংশীদারি দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন। কোনো স্টার্টআপের মালিকানায় একাধিক ব্যক্তি থাকলে দক্ষ কোনো ব্যক্তিকে মেন্টর হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। তিনি তখন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারবেন। সাধারণ ভুলগুলো এড়িয়ে চলুন। কোনো বিষয়ে সহ-প্রতিষ্ঠাতারা একমত না হলে তাঁর দ্বারস্থ হতে পারবেন। খরচ কমানোর জন্য ফ্রিল্যান্সার নিতে পারেন। যেমন—ফুড ডেলিভারিভিত্তিক স্টার্টআপ হলে ফুড ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ফ্রিল্যান্সার ডেলিভারিম্যান নিয়োগ দিতে পারেন। কাজ অনুসারে সে টাকা পাবে। আপনার মাথা থেকে মাসে মাসে নির্দিষ্ট খরচের চিন্তা আর থাকবে না।
পুঁজি সংগ্রহ করুন
যেকোনো স্টার্টআপের সফলতা নির্ভর করে কম সময়ে বেশি ক্রেতা ধরার ওপর। কাজটি করার জন্য প্রচুর বিপণন করতে হয়। জনবল নিয়োগ দিতে হয়। অনলাইনে প্রচার করতে হয়। প্রথম দিকে বেশির ভাগ স্টার্টআপ বাজার ধরার জন্য মূল্য ছাড় দিয়ে থাকে। অনলাইন-অফলাইনে প্রচুর প্রচার করে থাকে। এতে স্টার্টআপটি তার নির্দিষ্ট ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর কাছে সহজে পৌঁছে যায়। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে। এ সময় স্টার্টআপটি বড় করার জন্য পুঁজির প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপ ইকো সিস্টেম গড়ে উঠেছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা সম্ভাবনাময় স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করে থাকে। এসব বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্টার্টআপগুলোকে নিজেদের মালিকানা শেয়ার করতে হয়। বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করা উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গুগল’, ‘ওয়াই কম্বিনেটর’, ‘অ্যাকসেলারেটিং এশিয়া’ প্রভৃতি।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’, ‘জিপি অ্যাকসেলারেটর’, ‘আইডিএলসি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম’ প্রভৃতি।
সম্প্রতি ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ একাডেমি (আইডিয়া) প্রজেক্টের ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’কে কম্পানি হিসেবে নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ সরকার। ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের এ প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন থাকছে ১০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকো সিস্টেমকে বিকশিত করতে কাজ করছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠান। স্টার্টআপ বাংলাদেশ বিনিয়োগ করার সময় আইডিয়া পছন্দ হলে আইডিয়া পর্বেই কোনো ধরনের মালিকানা ছাড়াই ১০ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে থাকে। পণ্য তৈরি হওয়ার পর স্টার্টআপ পছন্দ হলে স্টার্টআপ বাংলাদেশসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো মালিকানার বিনিময়ে বিনিয়োগ করে থাকে। এ ছাড়া পরিচিত বা অপরিচিত কোনো ব্যক্তি আপনার ব্যবসা পছন্দ হলে স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে পারে।
স্পিচডেক হোক সুন্দর
বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগ চাওয়ার সময় স্পিচ বা নিজেদের আইডিয়া উপস্থাপন করতে হয়। আপনার স্পিচ যত ভালো হবে, আপনার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে তত বেশি আগ্রহী হবেন। এ স্পিচ তৈরি করার সময় সমস্যা, সমাধান, বাজারের আকার, ব্যাবসায়িক মডেল পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কোনো বিনিয়োগকারীর কাছে স্পিচ প্রদান করার জন্য যাওয়ার আগে আপনি বারবার স্পিচ অনুশীলন করুন। কী ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, তার উত্তর প্রস্তুত করে রাখুন। স্পিচ দেওয়ার সময় প্রেজেন্টেশনের স্লাইড তৈরি করতে হয়। সাধারণত বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট ফরম্যাট থাকে। সে ফরম্যাট অনুসারে প্রেজেন্টেশনের স্লাইড রেডি করুন এবং স্পিচ অনুশীলন করুন। পাশাপাশি খেয়াল রাখবেন, ভালো পিচ দিলেই বিনিয়োগকারীরা আপনার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করবেন এমন নয়। আপনার ব্যবসা পছন্দ হলে তবেই তারা বিনিয়োগ করবে। তাই কোনো স্পিচ সফল না হলে ভেঙে পড়বেন না।
ব্যাবসায়িক মডেল হোক পরিষ্কার
আপনার স্টার্টআপকে বড় করতে হলে এবং বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে পরিষ্কার ব্যাবসায়িক মডেল থাকতে হবে। যেমন—পাঠাও সার্ভিসের মাধ্যমে যাত্রীরা গন্তব্যে গেলে যেকোনো ট্রিপের জন্য ২০ শতাংশ কমিশন নিয়ে রাখে পাঠাও কর্তৃপক্ষ। আপনার স্টার্টআপের ক্ষেত্রেও পরিষ্কার বিজনেস মডেল থাকতে হবে। এতে আপনি যেমন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন, আপনার স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোও ভরসা পাবে। জনপ্রিয় কিছু বিজনেস মডেল হলো মার্কেটপ্লেস মডেল, অগ্রিম পারিশ্রমিক মডেল, সাবস্ক্রিপশন মডেল, ঘাটতি মডেল এবং পণ্য পরিষেবা মডেল।
সব স্টার্টআপ কি সফল হয়?
সব স্টার্টআপ সফল হয় না। সাধারণত ১০টি স্টার্টআপের ৯টি স্টার্টআপই দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। এসবের সফল না হওয়ার কারণে মধ্যে বাজার বুঝতে না পারা, সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ঝামেলা, সঠিক সময়ে বিনিয়োগ না পাওয়া প্রভৃতি রয়েছে।
আপনার যদি সুন্দর একটি আইডিয়া থাকে এবং দল গোছাতে পারলে চালু করতে পারেন স্টার্টআপ। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনার প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করতে পারেন শতকোটি টাকার কম্পানিতে।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ স্টার্টআপদের কী কী সুবিধা দিয়ে থাকে?
স্টার্টআপদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকি। স্টার্টআপ সংস্কৃতিকে জোরদার করতে কো-ওয়ার্কিং স্পেসের সুবিধাও দিয়ে আসছি। জানুয়ারি থেকে স্টার্টআপগুলোকে সিড স্টেজে ফান্ডিং দেওয়া শুরু করব। নির্দিষ্ট পরিমাণ মালিকানার বিপরীতে স্টার্টআপগুলোকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ফান্ডিং করা হবে। এ ছাড়া ‘স্টুডেন্ট টু স্টার্টআপ’ ইভেন্টের মাধ্যমে ছাত্রদের উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ থেকে ফান্ডিং পাওয়ার উপায় কী?
যেকোনো বয়সী বাংলাদেশি স্টার্টআপ বাংলাদেশ থেকে ফান্ড নিতে পারবেন। নির্ধারিত www.startupbangladesh.gov.bd ওয়েবসাইটে আবেদন করলে প্রাথমিকভাবে তাদের আইডিয়া মূল্যায়ন করি। আইডিয়া পছন্দ হলে তাদের স্পিচ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। আমাদের নির্বাচক কমিটির সদস্যরা স্পিচ দেখে সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে বিনিয়োগ করবেন কি না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
বাংলাদেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি বিকশিত করতে কাজ করছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এক হাজারটি সফল স্টার্টআপ তৈরি করতে চাই। বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করার জন্য আন্তর্জাতিক রোড শো আয়োজন করব। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে স্টার্টআপদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
সুত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন
0 Comments