মা-বাবাকে সন্তানদের গুণগত সময় দিতে হবে

একটি পত্রিকার চেয়েও বেশি। কেননা পত্রিকার দায়িত্বের বাইরেও তারা অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। সমাজ বিবর্তন এবং সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষণ ও ধরনগুলো বৈজ্ঞানিক জরিপের মাধ্যমে তুলে ধরা তেমন একটি মহৎ উদ্যোগ। ২০১৭-এর পর এবার ২০১৯ সালেও পরিবার ও মা-বাবা নিয়ে তরুণদের ভাবনা কী, সে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে প্রথম আলো  পত্রিকায়। জরিপে এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে, যা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয় এবং এর যথাযথ মূল্যায়ন করে এসবের প্রতিকার বের করা জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
মোটাদাগে জরিপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে কি না, পারিবারিক বন্ধন কমে গেছে কি না, তরুণেরা কাদের সঙ্গে নিজেদের সুখ-দুঃখ বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন ইত্যাদি। একই সঙ্গে এসবের কারণ কী, এমনকি সমাধান কী, তা-ও জরিপে তুলে ধরা হয়েছে।
পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে
জরিপে দেখা যায়, মা-বাবার সঙ্গে তরুণদের দূরত্ব বাড়ছে, যার হার ৭৮ দশমিক ১ শতাংশ। পারিবারিক বন্ধন কমেছে ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ বলে তরুণেরা মনে করেন। এই দূরত্ব বৃদ্ধি ও বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যে হতাশা, মাদকাসক্তি, অবসন্নতা, নৈতিক স্খলন প্রভৃতি বেড়েছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়। এ রকম ফলাফলকে যথার্থ বলে মনে হয়। কেননা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, বলিষ্ঠ আত্মপরিচিতি গঠন, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান গড়ে ওঠার মূল পাটাতন হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন ও মা-বাবার সঠিক সন্তান লালন-পালনের কল্যাণকর প্রভাব। মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে বা পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হলে সন্তানদের এ রকম বিচ্যুতি স্বাভাবিক।
জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ মা-বাবার কর্মস্থলে ব্যস্ততা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়া। কর্মস্থলে থাকার কারণে যে সময় কম দেওয়া, সেটির ঘাটতি মা-বাবা পূরণ করতে পারে ‘গুণগত মানের’ সময় দিয়ে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি থাকলে সন্তানেরা এর অনুসরণ করবে এবং সন্তান যথাযথ মনোযোগ ও যত্ন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই তাদের এই নিজেদের আসক্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং সন্তানদেরও এসব বিষয়ে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এই জরিপে আরও দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী অবসর সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করে থাকে এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এ হার অনেক বেশি, ৭০ শতাংশ। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ হার আরও বেশি হতে পারে। তবে কত ঘণ্টা সময় ব্যয় করে, সে তথ্যটুকু আরও জরুরি ছিল। তরুণেরা এ জন্য খেলাধুলা ও শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকার সুযোগের অভাবকে দায়ী করেন। তবে বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনা, সুস্থ বিনোদনের অভাব, মা-বাবা, শিক্ষকদের তদারকি, নজরদারির অভাবসহ আরও অনেক উপাদানও দায়ী।
কিছুসংখ্যক তরুণ এর কিছু সুফলের কথাও উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে, এসব সামাজিক মাধ্যমে লেখাপড়ার কাজে, উৎপাদন ও উপার্জনের কাজে, চাকরিবাকরি, পরীক্ষার প্রস্তুতি, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনসহ প্রভূত কাজে লাগে। এর সঙ্গে আমরাও একমত। আধুনিক প্রযুক্তির কিছু কুফল থাকলেও এর উপকারিতা অসীম। শুধু প্রয়োজন ওই সব কুফল এড়িয়ে কীভাবে এর সঠিক ও গঠনমূলক ব্যবহার বাড়ানো যায়, সে রকম প্রয়োগ কৌশল তাঁদের শিখিয়ে দেওয়া।
মা সর্বকালের ভরসা, কিন্তু বেচারা বাবা
জরিপে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণের মূল ভরসা মা। গ্রামে এ হার কিছুটা বেশি। অথচ বাবার প্রতি ভরসা মেয়েদের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ও ছেলেদের ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। জন্ম থেকেই মায়ের সঙ্গে সব সন্তানের একটি ‘আত্মিক বন্ধন’ তৈরি হয়। শৈশবের পুরো সময় সব ধরনের প্রয়োজন, চাহিদা, নিরাপত্তা, যত্নের মূল দায়িত্ব পালন করেন মা। এমনকি কৈশোর-তারুণ্যেও এই নির্ভরশীলতা অটুট থাকে। বাবারা হন খেলার সাথি। বাবারা নিজেরাও, এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও তাঁদের মায়েদের ওপর ভরসা রাখেন। প্রকৃতির এ এক অমোঘ নিয়ম। তবে লক্ষণীয়, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বাবার কাছে বেশি ভরসা রাখে, যদিও বন্ধুর তুলনায় খুবই কম। এর কারণ লিঙ্গ, সমাজ, কর্মপরিধি ও বাস্তব প্রয়োজন। কিন্তু আশঙ্কার কথা, ছেলেদের এই ভরসা যত দিন যায়, তত কমতে থাকে। জরিপে দেখা যায়, বাবার প্রতি এই ভরসা ১৫-১৯ বছরে যেখানে ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ, সেটি ২৫-৩০ বছরে কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। হায়! বেচারা বাবা।
হতভাগ্য স্ত্রী-ভাগ্যবান বন্ধু
জরিপে দেখা যায়, ছেলেরা সমস্যার কথা, সুখ-দুঃখের কথা বেশি শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে, ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ; এরপর মা, ৫২ দশমিক ১ শতাংশ; এরপর বাবা, ৩২ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সর্বশেষে হতভাগ্য স্ত্রী/সঙ্গিনী, মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এমনকি ভাইবোনের চেয়েও কম আলোচনা করেন সঙ্গিনীর সঙ্গে।
পুরুষদের এই অতিরিক্ত বহুমুখিতা, সংসারবৈরাগী মনোভাব, পরিবার ও সমাজে অনেক বিড়ম্বনা, কষ্ট, জটিলতার জন্য দায়ী। দাম্পত্য
জীবনে বহুবিধ আবেগগত, মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক নারী আমাদের কাছে এসে থাকেন। এর বেশির ভাগ কারণ স্বামীর কাছ থেকে অবজ্ঞা, অবহেলা, নির্যাতন। স্ত্রী/সঙ্গিনীর প্রতি অমনোযোগ, অনাগ্রহ, অযত্ন, যোগাযোগহীনতা দাম্পত্য কলহ ও অশান্তির অন্যতম কারণ।
অথচ জরিপে দেখা যায়, ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ নারী সঙ্গী/স্বামীর সঙ্গেই সুখ-দুঃখের কথা বলে থাকেন। মূলত মায়ের পর মেয়েরা সঙ্গীর সঙ্গে বেশি শেয়ার করেন।
এদিকটি তাই খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। পুরুষ স্বভাবের এই মন্দ দিক নিয়ে সব পুরুষকে গভীরভাবে পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে।
এ প্রজন্মের বড় সমস্যা মানিয়ে নিতে না পারা
পরিবার, সমাজ, জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের উদ্বেগ উল্লেখযোগ্য। এই মানিয়ে নিতে না পারার হার মেয়েদের মধ্যে বেশি, ৭৫ শতাংশ। জরিপে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের এই উদ্বেগ এত বেশি যে তা জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, চাকরিবাকরি বা পড়াশোনা—কোনোটাই নাকি এর মতো সমান উদ্বেগের বিষয় নয়। মূলত কৈশোর-তারুণ্য সময়টি জীবনের একটি সন্ধিক্ষণ। এ সময়ে শারীরিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানসিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক বিকাশ তেমন এগোতে পারে না। একদিকে মনে হয় তারা বড় হয়ে গেছে, তারা নিজেরাও তেমনটা ভাবে। অথচ বাস্তবে তাদের মনন সে রকম পরিপক্ব নয়। এ জন্য তাদের জীবন, সমাজ এমনকি নিজের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করে যেতে হয়। সেই যুদ্ধ খুবই অসম। তাই তাদের মনে হয় আমি বেমানান, আমি কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নিতে পারছি না। অভিভাবক, শিক্ষকদের এ সময়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তা না হলে তারা দিশেহারা, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যেতে পারে। এ সময় তাদের প্রয়োজন সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সমর্থন ও ভালোবাসা; উপদেশ বা কঠোর শাসন নয়।
সামাজিক বন্ধনও শিথিল হচ্ছে
৮৫ শতাংশ তরুণ বলছেন, তাঁদের সামাজিক বন্ধনও কমে যাচ্ছে। এটা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়, কেননা পারিবারিক বন্ধন কমে গেলে সামাজিক বন্ধন অটুট থাকবে কীভাবে? তরুণ প্রজন্মের বিপথে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হওয়া।
ভয়ংকর সংবাদ—কারও প্রতি আস্থা নেই
এতক্ষণ অনেক নেতিবাচক তথ্যের উল্লেখ করলাম, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ৬–৭ শতাংশ তরুণ কারও ওপরই ভরসা করতে পারছেন না। এ হার শহরে আরও বেশি, ৯ শতাংশ। যে মানুষ কারও ওপর আর ভরসা রাখতে পারেন না, মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধু, সমাজ—কারও ওপর যাঁদের ভরসা নেই, তাঁরা নিজেদের জন্য যেমন, তেমনি সমাজের জন্যও হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকর। পুরো আশাহীন, অসহায় মানুষ হয় নিজেকে শেষ করে দিতে চাইবেন, নতুবা চারপাশের সবকিছু চুরমার করে, লন্ডভন্ড করে, হতাশা, অসহায়ত্বের ভার লাঘব করতে চাইবেন।
এখন সমাজ, রাষ্ট্র কি এঁদের কোনো ভরসা দিতে এগিয়ে আসবে? জরিপের এ রকম ফলাফলকে পাল্টে দিতে, অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, তথ্যমাধ্যম, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে ইতিবাচক, শুভ উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। আমরা সবাই একটি মানবিক, মননশীল, সৃজনশীল, আশাবাদী, কর্মমুখী, জীবনমুখী ও প্রাণোচ্ছল প্রজন্ম দেখতে চাই।
ডা. মো. তাজুল ইসলাম: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
drtazul 84 @gmail

Post a Comment

0 Comments