যখনই
কোনো সন্তানের জন্ম হয়, বেশির ভাগ লোক এটা ধরে নেন যে, তখনই তাদের শিক্ষক
হওয়ার সময় এসে গেছে। যখন আপনার বাড়িতে একটি শিশুর আগমন ঘটে, তখন সেটা
শিক্ষক হওয়ার সময় নয়, এটা শেখবার সময়, কারণ আপনি যদি আপনার নিজের দিকে
তাকিয়ে দেখেন এবং সন্তানের দিকে দেখেন, দেখবেন আপনার সন্তান অনেক বেশি
আনন্দময়, তাই না? তাই এটা আপনার তাদের কাছে জীবনের শিক্ষা নেওয়ার সময়,
উলটোটা নয়।
একমাত্র জিনিস যেটা আপনি নিজের সন্তানকে
শেখাতে পারেন, সেটা হলো—কীভাবে জীবনটা টিকিয়ে রাখতে হবে। শুধু এটুকুই আপনার
করা প্রয়োজন; কিন্তু স্বয়ং জীবনের কথা যখন আসে, একটি শিশু অনুভবের স্তরে
নিজে থেকেই জীবনের বিষয়ে অনেক বেশি জানে। সে নিজেই জীবন; এটা সে জানে।
এমনকি আপনিও, যদি আপনার মনের ওপর যেসব প্রভাবগুলো চাপিয়ে দিয়েছেন, সেগুলো
সরিয়ে নেন, তাহলে আপনার প্রাণশক্তিও জানে ঠিক কীভাবে ‘থাকা প্রয়োজন’। শুধু
আপনার মনটাই জানে না ঠিক কীভাবে ‘হতে হয়’। একজন মানুষ অনেক রকমের যন্ত্রণা
ভোগ করার ক্ষমতা রাখেন—কল্পিত যন্ত্রণা। একটি শিশু এখনো সেই জায়গায়
পৌঁছয়নি।
তো এটা হলো শেখার সময়, শেখানোর নয়। একমাত্র
যা আপনি দিতে পারেন তা হলো শিশুটির বেড়ে ওঠার জন্য এক স্নেহ, যত্ন আর
সাহায্যের পরিবেশ। ভালোভাবে সন্তান মানুষ করার মানে সন্তানকে এটা শেখানো নয়
যে, কী করতে হবে আর কী করতে হবে না, এটা শুধুই এক রকমের পরিবেশ তৈরি করে
তোলা। আপনি যদি আপনার বাগানকে বিকশিত করতে চান, তাহলে আপনি সেখানে প্রতিদিন
বসে থেকে ফুল আর ফল আদায় করার চেষ্টা করবেন না। আপনি শুধু বাগানের
পরিবেশটা বজায় রাখেন, আর তাতেই বাগানটা সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে, তাই না?
এতটুকুই আপনি করতে পারেন, আর এতটুকুই আপনার করা উচিত।
বাবা-মায়েরা যদি সত্যিই সন্তানদের নিয়ে
চিন্তিত থাকেন, তাহলে তাদের অবশ্যই উচিত সন্তানদের এমনভাবে মানুষ করা যাতে
তাদের কখনোই বাবা-মায়ের কোনো প্রয়োজন না পড়ে। স্নেহ-ভালোবাসার প্রক্রিয়াটা
সব সময়ই স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়া হওয়া উচিত, আবদ্ধ হয়ে পড়ার প্রক্রিয়া নয়।
তাই যখন শিশুর জন্ম হলো, তখন তাকে তার চারিদিকে দেখতে দিন, প্রকৃতির সঙ্গে
সময় কাটাতে দিন এবং সময় কাটাতে দিন তার নিজের সঙ্গে। ভালোবাসা ও সাহায্যের
একটি পরিবেশ গড়ে তুলুন। আপনার নৈতিকতা, আপনার ধারণা, আপনার পছন্দ-অপছন্দ বা
আরো কিছু তার ওপরে কোনোভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। শুধু তাকে
বেড়ে উঠতে দিন, তার বুদ্ধিমত্তাকে বিকশিত হতে দিন। পরিবার বা আপনার ধনসম্পদ
বা অন্য কিছুর সঙ্গে চিহ্নিত না হয়ে, একজন মানুষ হিসেবে তার নিজের
জীবনটাকে তার নিজের শর্তে দেখতে সাহায্য করুন। একজন মানুষ হিসেবে জীবনের
দিকে চেয়ে দেখতে সাহায্য করুন—এটা অত্যন্ত জরুরি। এটা তার ভালো থাকার জন্য
এবং দেশেরও ভালো থাকার জন্য একান্তই আবশ্যক।
বাড়িটা আপনার সন্তানের ওপরে আপনার সংস্কৃতি,
আপনার ধ্যানধারণা অথবা আপনার নৈতিকতা চাপিয়ে দেওয়ার জায়গা হওয়া উচিত নয়।
এটি এমন এক সহায়ক পরিবেশ হওয়া উচিত যেখানে তার ওপরে কোনো কিছু আরোপিত নয়,
যেখানে তার বুদ্ধিমত্তাকে উত্সাহ দেওয়া হবে। যদি আপনার সন্তান বাড়িতে বেশি
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে বাইরের থেকে বাড়িতে বেশি
সময় কাটাবার চেষ্টা করবে; কিন্তু এখন, বাড়ির পরিবেশ বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ার
কারণে, একটা রাস্তার কোণ হয়তো তার কাছে বাড়ির তুলনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের
জায়গা মনে হয়। তাই যদি বাড়িতে এই অস্বস্তিবোধ না থাকে, সে রাস্তার কোণে
গিয়ে আশ্রয় নেবে না; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে জগতের রূঢ় বাস্তবের
সম্মুখীন হবে না। তা তো সে হবেই এবং সেগুলো কোনো না কোনোভাবে তাকে প্রভাবিত
করবে। সন্তানকে নিজেই নিজের জন্য চিন্তা করা শিখতে দেওয়া এবং তার নিজের
বুদ্ধি খাটিয়ে এটা বুঝতে দেওয়া যে তার নিজের জন্য সব থেকে ভালো কী।
বাবা-মায়ের এভাবে সন্তানকে উত্সাহিত করাটাই সন্তানের ভালোভাবে মানুষ হয়ে
ওঠার জন্য শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। সৌজন্যে : ঈশা ফাউন্ডেশন।
0 Comments