কুরবানি ও গরু, সুশীল ও শূকর

মধ্যযুগীয় ভয়াবহ বর্বরতাগুলোর একটার নাম কুরবানি। অবলা প্রাণীর গলায় ছুরি চালায়া উল্লাস কেবল মুসলমানগো পক্ষেই সম্ভব। এদের মাঝে আছেই তো হিংস্রতা! অথচ আপনি ইউরোপে যান, এমন অবাধে নির্মম পশুহত্যা দেখবেন না। সেখানে পশু জবাই করতে হয় নির্দিষ্ট কসাইখানায়। তাও ধরাবাঁধা নিয়ম আছে— কোনোটাতে দিনে পাঁচটা, কোনোটাতে সাতটা, কোনোটাতে দশটা পশু জবাই করতে পারবেন। জবাইর আগে এ পশুর মাংসে যে ক্ষতিকারক কোনো ইফেক্ট নাই, তার ডাক্তারি সার্টিফিকেট থাকতে হবে। ডাক্তার হতে হয় সরকারি রেজিস্টার্ড। পশুর বয়স কম হলেও হবে না। সময়ের ভেতর মাংস বিক্রি করে শেষ করতে হবে। সেখানকার শিশুরা পশুহত্যার পিশাচী বর্বরতা থেকে পাষণ্ড মানসিকতা নিয়ে বড় হতে হয় না। অথচ মুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে দেখুন, প্রকাশ্যে পশুহত্যার মাধ্যমে শিশুদের মনোজগতে জঙ্গি জঙ্গি ভাব কীভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে!
   গরু একটা রোগবাহী জীব। এর মাংস আপনার শরীরে গেলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে আপনাকে ক্যান্সার হৃদরোগের মতো ভয়াবহ বিমারিতে ভুগতে হবে।
   .
   প্রতিবার কুরবানি এলেই বঙ্গীয় সেক্যুলার কেলা বিগ্যানিকূলের এইসব গ্যান ঝাড়তে দেখা যায়। বাঙালি জাতিটার বড় একটা অংশ যে যথেষ্ট পরিমাণে আবাল, সেটা বোঝা যায় এই ধরনের কথা শুনে কারো মন গলে যেতে দেখলে। আবাল দুই প্রকার, এক প্রকার আবাল এইসব পেশাব দেখলেই উহ আহ শুরু করে। তারপর বাছবিচার না করেই নিজেই সেই দলে ঢুকে যায়। এরা অধিকাংশই শিক্ষিত। শিক্ষিতরও আবার প্রকারভেদ আছে, নকলবাজ শিক্ষিত, অস্ত্রবাজ শিক্ষিত, ধাপ্পাবাজ শিক্ষিত, চাপাবাজ— বাস্তবে মেট্রিক পাশ, ভাব নেয় ফিজিক্সে ডাবল ডিগ্রি—শিক্ষিত। এই শিক্ষিতরাই আবাল শিক্ষিত। দ্বিতীয় প্রকার আবাল হল হুজুগে জাতি। এদের বড় অংশ অশিক্ষিত এবং সেকেন্ড অংশ মাদরাসার ছাত্র। এরা যতোটুকু না বিবেকে চলে, তারচেয়ে বেশি অবেগ বোঝাতে চায়। সেখানেই তাদের হুজুগেপনা জাহের হয়ে যায়। এরা নাস্তিক্যবাদ পোস্ট দেখলেই সমস্ত আবেগ নিয়ে পবিত্র গালিগালাজ শরীফ মোবারক (!) নিয়ে লাদায়া লাফায়া কমেন্ট করে। কেন যে করছে, নিজেও জানে না। অথচ আমরা যারা বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্লাটফর্ম তৈরির সংগ্রাম করে যাচ্ছি, এই হুজুগে প্রজাতির কারণে পরিকল্পনা এবং সাফল্য মাঠে মারা পড়ে।
   .
   বলছিলাম মুসলমানদের কুরবানি এবং বঙ্গীয় পশুবাদীদের আবালগিরির কথা।
   তাদের মতে কুরবানি একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মধ্যযুগে কী ছিল? মানুষ ছিল প্রাণী ছিল। যেখানে প্রাণের সন্ধান আছে, সেখানে অবশ্যই খাদ্যের নিয়ম আছে! থাকতেই হবে।
   বিজ্ঞান খাদ্যজালের সূত্র দিয়েছে। মনে করেন গরু বছরে একটা বাছুর বিয়ায়। গরু একটা বংশবৃদ্ধিকারক প্রাণী। পৃথিবীতে গরু আছে ধরুন দশ কোটি। এদের মধ্যে গাভী আছে চার কোটি। এরা সবাই বাছুর দিলে আগামী বছর গরুর সংখ্যা দাঁড়াবে চৌদ্দ কোটি। পরের বছর গাভীর সংখ্যা ধরুন ছয় কোটি। সবগুলো বিয়ালে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে বিশ কোটি।
   এভাবে ছাগল, মহিষ, দুম্বা, বাঘ হরিণ, কুকুর, শৃগাল— অবলা প্রাণীতে ভরে যাবে পৃথিবী।
   পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। খুবই ছোট। কত ছোট? বিজ্ঞান বলে, সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর একশত নয় গুণ। মানে আপনি আমাদের গোটা পৃথিবীটা সূর্যের ভেতরে একপাশে রাখলেন, তারপর সমান আয়তন, ভর ও ব্যাসের আরেকটি পৃথিবী ওই সিরিয়ালে তার পরে বসালেন। এভাবে একে একে একশো নয়টি পৃথিবী বসালে যদ্দুর হবে, সূর্যের ভেতরের অংশের ব্যাস সে সমান। মোট তেরো লক্ষ পৃথিবী ভরলে আপনি সূর্যের ভেতরের অংশ পূরণ করতে পারবেন।
   এই এতোটুকু 'পিচ্চি' একটি গ্রহ অর্থাৎ পৃথিবীর ভেতর অংশে যে পরিমাণ স্থান আছে, তার সাতাত্তর শতাংশ পানি। সাগর নদী পুকুর খাল জলপ্রপাত ঝর্ণা ছড়ি। মাত্র তেইশ শতাংশ স্থল ভূমি। স্থলচর প্রাণী— মানুষ, গরু ছাগল, বাঘ, ভল্লুক, উল্লুক— বাস করে তেইশ শতাংশের এই অল্প পরিসরে।
   এখন যদি শুধু গরুই বছর বছর কোটি কোটি বাড়তে থাকে, পৃথিবীতে অন্য প্রাণী বসবাসের জায়গা অবশিষ্ট থাকতে হবে না। এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা যে পদ্ধতিটি দিয়েছেন, তার মাঝে খাদ্যের দিক থেকে প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস। কিছু প্রাণী মাংসাশী। এরা অন্য প্রাণীদের মাংস খায়। কিছু তৃণভোজী। এরা ঘাস বিচুলি লতাপাতা খায়। সহজ ভাষায় এই পদ্ধতিটাকেই বিজ্ঞান খাদ্যজাল বলে।
   মধ্যযুগ না কেবল, আদিকাল থেকেই মানুষসহ সব প্রাণীই এই নিয়মের ভেতর দিয়ে আসছে।
   নবীজি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যখন মানুষ পাশবিকতা ছেড়ে একটা সিস্টেমের আওতায় আসতে শুরু করেছে, তখন পশুর মাংস ভক্ষণের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। যেসব প্রাণীর মাংস মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক, সেগুলো নিষেধ করা হয়। নিষিদ্ধের এই নিয়মটার পারিভাষিক নাম 'হারাম'। শূকরের মাংস হারাম, কেন হারাম? কী ক্ষতি আছে তাতে? আমি "শূকর প্রসঙ্গ" শিরোনামের লেখায় তাতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছি, শূকর কেন খাওয়া যাবে না এবং বঙ্গীয় সুশীলকূলের কাছে এ মাংস কেন এতো প্রিয়!

   মানুষ যেভাবে মাংস ভক্ষণ শুরু করেছিল, তার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম করেছে ইসলাম। আপনারা সব প্রাণীর গোস্ত যথেচ্ছা ভক্ষণ করতে থাকলে ডাইনোসরের মতো হাতি জিরাফ গণ্ডারও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ জন্য কিছু প্রাণীকে হালাল করে বাকিগুলোকে হারাম করেছে। কেন করেছে, তার আরও যতোগুলো কারণ আছে, সব ইসলাম দেখিয়েছে। শুধু তাই না, জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নিতে বলেছে। আপনি একজনের একটি বালতি ব্যবহার করছেন, তার অনুমতি না নিয়ে করে থাকলে ভেতরে পাপবোধ জাগবে। নিজেকে অপরাধী মনে হবে। যার সৃষ্টি জীবিত প্রাণী আপনি জবাই করে নিষ্প্রাণ করে খাচ্ছেন, এখানেও তার অনুমতি না নিলে আপনার ভেতর পাপবোধ জাগা উচিত। নইলে আপনি মানুষ না, পশু। পশু যেমন শিকার ধরে খায়, আপনিও খান। এই অনুমতিটার জন্য "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর" বলে জবাই করার বিধান এসেছে।
   এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কুরবানি কেন? নির্দিষ্ট দিনে গরু জবাই করে মৃত প্রাণীকে কেন্দ্র করে আনন্দে মাতাটা নিশ্চয়ই পাশবিকতা!!
   জ্বি, অবশ্যই পাশবিকতা। মুসলমানদের দুটি আনন্দের কোথাও নাচানাচির নিয়ম নেই। গরু জবাই করে কেউ নাচানাচি করেও না। বরং গোসল করে ঈদগাহে গিয়ে খোদার দরবারে মিনতিভরে জামাতের সঙ্গে দুই রাকাত নামায পড়ে। কুরবানির দিন ফজর থেকে উপোষ থাকে, খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে যায়।
   আপনারা যারা সুশীল, পেটের জন্য গরিব দেখেন না, মুসলমানরা কুরবানি করে সেই গোস্তের তিন ভাগের এক ভাগ এই গরিবদের মাঝে বিলায়। বছরের অন্তত এই একটা উপলক্ষ্যে দরিদ্র দেশের নিঃস্ব মানুষগুলো দুচার টুকরো গোস্ত খেয়ে খুশি হতে পারে। তাদের সে খুশির বন্দোবস্ত করেছে ইসলাম, আপনাদের সেক্যুলার ধর্ম করেনি।

   কুরবানিতে ছয়টি প্রাণী জবাইয়ের অনুমতি রয়েছে। এর মধ্যে গরু ছাগল মহিষ বাংলাদেশে প্রচুর হয়। কেলা বিগ্যানিদের যতো চুলকানি, সব গরুতে। ছাগল দিয়ে তো হিন্দুরা মূর্তির পদে পাঁঠাবলি দেয়! ছাগল নিয়ে কিছু বললে নিজেরাই গ্যাঁড়াকলে পড়বে। মহিষ নিয়েও তেমন মাতামাতি করে না, কারণ ভারতে অনেক প্রদেশে দূর্গা পূজায় মহিষ বলি দেয়ার প্রথা এখনও আছে।
   গরু নিয়ে সেক্যুলারবৃন্দের হাউমাউকাউ দেখে আমাদের হাসি পায়— অবজ্ঞার হাসি। তাদের মতে গরুর মাংসে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল আছে। এই কোলেস্টেরল তো চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, ডিমের মধ্যেও আছে! চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে মানবদেহে কোলেস্টেরল হয় দুই ভাবে। ১. অনেকের শারীরিক প্রবৃদ্ধিই এমন। বংশগতভাবে যেমন মানুষ ভারী স্বাস্থের হয়, বংশগতভাবেই তাদের কোলেস্টেরল হয়। ২. খাবার থেকে। চর্বিযুক্ত খাবার এর জন্য দায়ী। ক্যালরির পরিমাণ ঠিক না রাখলে যে কোনো খাদ্যই আপনার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। (যদিও সম্প্রতি হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে পুষ্টিবিদ লিজ উলফি ডিমের কুসুমে কোলেস্টেরল নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন।)
   গরুর মাংসের ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রমাণ করে— মাংস প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। গরুর মাংস অনিয়ন্ত্রিত ভক্ষণ করলে দেহে কোলেস্টেরল হতে পারে। অন্য খাদ্যের ব্যাপারেও একই কথা। যদিও আমাদের কেলা বিগ্যানিদের সমস্ত গ্যান গরুবিদ্যায় রূপ নিয়েছে। নিজেরাই বিফ বার্গারে কামড় বসিয়ে আমাদের মতো সাধারণ পাবলিককে নসিহত করে বিফ (গরুর মাংস) খেয়ো না। এটা ক্ষতিকারক। ব্যাপারটা এমন, একজনের সমস্ত গায়ে গু মেখে আছে, সে আরেকজনের স্যান্ডেলের তলায় সামান্য গু লাগতে দেখে বলে, 'উঁহ, তোর গা থেকে গুর গন্ধ আয়ে'।
   গরুর মাংসে পুষ্টি-উপাদান বেশি হওয়ায় পরিমাণের বেশি খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। দৈনিক গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাপ হল তিন আউন্স বা পঁচাশি গ্রাম। এ পরিমাণ খেলে আপনার শরীরে দিনে চাহিদার মাত্র ১০% ক্যালরি আসবে। (৩ আউন্স মাংসে আছে ২০০ ক্যালরি এবং দৈনিক ক্যালরির চাহিদা ২০০০ করে।) এ পরিমাণ মাংস হার্টের কোনো ক্ষতিই করে না। কারণ একজন সুস্থ মানুষের শরীরে কোলেস্টেরলের নিরাপদ মাত্রা ৩০০ মিগ্রা এবং হার্টের রোগীর জন্য ২০০ মিগ্রা। ৩ আউন্স মাংস যদি আপনি গরুর sirloin অংশ থেকে খান, কোলেস্টেরল উৎপন্ন হবে মাত্র ৪৭ আর round অংশে ৫৩ মিগ্রা।
   মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় নয়টি পুষ্টি সরবরাহে তড়িৎ ক্ষমতা রাখে গরুর মাংস। প্রোটিজিন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি ১২, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, নায়াসিন, ভিটামিন বি ৬, আয়রন এবং রিবোফ্লাভিন।
   গরুর মাংসে Conjugated Linoleic Acid (CLA) নামে একটি উপাদান আছে, যেটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সক্ষমতা বাড়ায়।
   ডিমে কোলেস্টেরলের ব্যাপারে রিপোর্টটায় প্রথম আলোর তথ্য হল, "চলতি বছরের শুরুর দিকে টাইম সাময়িকী তাদের ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যাতে বলা হয়েছিল— ডিম এবং অন্যান্য উচ্চমাত্রার চর্বিযুক্ত খাবার ক্ষতিকর।"
   কিন্তু শূকরের মাংস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তবু মাংসের তালিকায় আমাদের কেলা বিগ্যানিকুলের শূকরই পছন্দ। কী হবে আর! পশুমুরিদ নিজেকে বিগ্যানি দাবি করলে যা হয় আরকি! মূল কথা শূকর খেতে কুরআনে হারাম করেছে এবং গরুকে জায়েয করেছে অথচ গরু (গাভী) হিন্দুদের মা! কুরআন যদি শূকর খাওয়া হালাল করত এবং কুরবানি করতে বলত, কেলা বিগ্যানিদের তখন শূকর নিয়েই চুলকাতে দেখা যেত। তাদের সমস্যাটা পশুতে নয়, কুরআনে এবং ইসলামে।

Post a Comment

1 Comments

  1. এই লেখা কার? লেখকের নাম নেই কেন? যার লেখা কপি করে ছেড়ে দিয়েছেন, তার অনুমতিটুকু নিয়েছেন?

    ReplyDelete