আঞ্চলিক ভাষার টানাপড়েন



আমাদের ভূখ-জুড়ে আমরা একটিমাত্র ভাষায় সবাই কথা বলে থাকি এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা অনায়াসে বুঝতেও পারি। এটা কিন্তু আমাদের কম প্রাপ্তি নয়, অসামান্য প্রাপ্তিই বলা যায়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি অঞ্চলভেদে প্রচুর আঞ্চলিক ভাষাও রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর যেমন লিপি নেই, তেমনি সাহিত্যও, তবে প্রচুর গান আছে, আছে সুমধুর সুরও। আঞ্চলিক ভাষাগুলো টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। মানুষ যদি আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগ করে তবে আঞ্চলিক ভাষার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়বে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় সর্বাধিক দুর্বোধ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্য অঞ্চলের মানুষ খাস চট্টগ্রামের ভাষা বলা তো পরের কথা, বুঝতে পর্যন্ত পারে না। তাই অনায়াসে বলা যায় বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে যেসব আঞ্চলিক ভাষা আজও স্বকীয়তায় টিকে আছে তার মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অবশ্যই ব্যতিক্রম এবং স্বতন্ত্র।
কালের বিবর্তনে চট্টগ্রামের আদি ভাষার অনেক শব্দই ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। আমাদের কৈশোরে শোনা-জানা অনেক শব্দের এখন আর প্রচলন নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ওইসব লুপ্ত হয়ে যাওয়া শব্দ অজানাই হয়ে গেছে। সংস্কৃতির মতো ভাষাও পরিবর্তনশীল, সেটা স্বীকার করতেই হবে। সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন না হলেও অর্থনৈতিক কারণে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে বললে ভুল হবে না। আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপনে আধুনিক যান্ত্রিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। পারিবারিক পরিম-লে আঞ্চলিক কথোপকথন ছিল অবশ্যম্ভাবী। এখন সে স্থলে বাবা-মায়েরা সন্তানদের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে, আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগে। চট্টগ্রাম শহরের কথা বাদ দিলেও শহরতলি ও গ্রামে পর্যন্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগের হিড়িক পড়েছে। যেটা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। মুখ থেকে হারিয়ে গেলে আঞ্চলিক ভাষাও যে লুপ্ত হয়ে যাবে। সেটা খুবই বাস্তবিক সত্য। আর আঞ্চলিক ভাষার নানা উপাদানে মাতৃভাষার সমৃদ্ধির বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার টিকে থাকাটা জরুরি, সেটা কেবল আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োজনে নয়, মাতৃভাষার প্রয়োজনেও।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা কেন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আগেকার মতো ব্যাপকভাবে কেন ব্যবহার হচ্ছে না। তার প্রধানত কারণটি হচ্ছে অতি-আধুনিকতার স্থূল প্রবণতা। আগে প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার ছিল অনিবার্য। সেটা চট্টগ্রামের বাইরে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ঢাকা-কলকাতায় চট্টগ্রামের যারা বসবাস করতেন তারাও পারিবারিক পরিম-লে আঞ্চলিক ভাষায়ই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন চট্টগ্রামের বাইরে তো পরের কথা, খোদ চট্টগ্রাম শহর, শহরতলি, এমনকি গ্রামে পর্যন্ত পিতা-মাতারা সন্তানদের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে সন্তানদের আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগে বাধ্য করে তুলেছে। সীতাকু-ের গ্রামে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সন্তান মাকে বলছে, ‘ওমা আঁই আজিয়া স্কুলত জাইতান ন।’ শুনে মা আঁতকে উঠে ছেলেকে তীব্র তিরস্কারে বলে ওঠেন, ‘তুমি চিটাগাইংগা কথা বলছ কেন যে, তোমাকে না শুদ্ধ কথা বলতে বলেছি, এখন থেকে আর চিটাগাইংগা কথা বলবে না, শুদ্ধ কথা বলবে বুঝেছ।’ অর্থাৎ মা-বাবারা চট্টগ্রামের ভাষা পরিত্যাগে সন্তানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা ত্যাগে বাধ্য করে চলেছেন। যেটা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। আত্মঘাতী বলা যায়।
আমরা অনেক শব্দ বলেছি-শুনেছি যেগুলো এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন শৌচাগারকে টাট্টি, স্বামীকে নেক, বেতনকে তলব, ঘরের পুরাতন কালো হয়ে যাওয়া ছনকে কালাকাইট্টা, ডায়রিয়াকে দাস্ত, বরযাত্রী যাওয়ার আগে বরপক্ষের একজন প্রতিনিধি বর আগমনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে কনের বাড়িতে একদিন আগে পৌঁছে যেতেন; তাকে বলা হতো খৌগা। খৌগা পাঠানো ছিল অনিবার্য। অথচ এখন খৌগা পাঠানোর প্রচলন আর নেই। খৌগা নামটিও বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। টুপিকে তৈক্কা, কুপিকে হাতবাত্তি। চট্টগ্রামের স্থানীয় মহিলারা বার্মিজ মহিলাদের মতো সর্বাধিক থামি পরিধান করত। শাড়ি অতি নগণ্যসংখ্যকরা পরত। থামির এখন আর তেমন প্রচলন নেই। শাড়িই এখন সর্বাধিক মহিলারা পরে থাকে। থামি শব্দটিও লুপ্ত হওয়ার পথে। কৈশোরে দাড়িবান্ধা খেলার মতো কিশোর-তরুণরা পড়ো খেলা খেলত ফসল তোলার পর খালি জমিতে। এখন আর পড়ো খেলাও দেখা যায় না। পড়ো নামক খেলার নামটিও এখন অনেকেই জানে না। উঁচু কাঁচা ঘরে ওঠার লম্বা কাঠের পাটাতনকে ফৈডা, ছেলেশিশুকে ল্যাদাইয়া, মেয়েশিশুকে বাচুনি, বাড়ির চাকরকে গোড়ক পোয়া, সেফ করাকে মুকবানা, বিয়েকে হাঙ্গা, চিটাধানকে মুল্লিক্কা ধান, ঘরের পেছনের অংশকে বারিসদি। পেছনের দরজাকে বাইনদুয়ার, স্বল্পভাষীকে উড়গুইন্না, কাদাকে ফুট, মেঘাচ্ছন্নকে মেউলা, মাটির ঘরের মাচানকে দমদমা, বর্গা দেওয়াকে বাগা, ঠোঁটকে ওঁট, সুতাকে ফুতা, সন্ধ্যাকে আঁজুইন্না, ঘরের মাঝের উঁচু খুঁটিকে মআমুইন্না, দরজাকে কেবার, ভাবিকে বজ-ভাজি, বড় মোড়ককে রাতা, মইকে হাপটা, লেখার কালিকে সিয়াই, বাঁশঝাড়কে বাঁশডুয়া, চিরুনিকে ফুউনি। কলসকে ঘড়া, ভোররাতকে ফইত্তা, শুঁটকিকে ফুনি, ছারপোকাকে উরুশ, মজুরকে গওড়, বাজার করার ঝুড়িকে হাতা, মুড়িকে হুড়–ম, সরিষার তেলকে কৌড়গা তেল, চালভাজাকে কড়ই, হ্যাঁ-কে আয়-য় ইত্যাদি। এরকম অজস্র শব্দ এবং আচারের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। লুপ্ত হওয়া শব্দগুলো প্রসঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কাছে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাইনি। ওইসব সাবেকি প্রচলিত শব্দ তারা শোনেনি, তাই বুঝেও না। শুদ্ধ বাংলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ভেতর এক এক করে ঢুকে পড়ে আদি আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন স্থানীয়-বহুজাতিক শিল্প-কারখানায় বার্ষিক নাটক, বিচিত্রানুষ্ঠান হতো প্রতি শীত মৌসুমে। ঐতিহাসিক-সামাজিক নাটকের পাশাপাশি বিচিত্রানুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আবদুল আলীম, আবদুল জাব্বার, বশির আহমদ, মাহামুদুন নবী থেকে খ্যাতিমান শিল্পীরা গান পরিবেশন করতে যেতেন। সেসব অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান নিয়ে হাজির হতেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবসহ আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা। সেসব গানের কদর ও শ্রোতাদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। তাদের গাওয়া গানগুলো পরবর্তী সময়ে বিটিভিতে প্রচারের পর দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। চলচ্চিত্রেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান পরিবেশিত হওয়ার কারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। চট্টগ্রামের বিয়েশাদি থেকে সামাজিক অনুষ্ঠানেও অনিবার্য ছিল আঞ্চলিক গান। কিন্তু এখন ওইসব অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক গান তো পরের কথা বাংলা গানও গাওয়া হয় না। ব্যান্ড এবং হিন্দি গানের একক আধিপত্যে আঞ্চলিক এবং বাংলা গান বিদায় নিয়েছে।
আঞ্চলিকতার বৃত্তে আটকে থাকা নিশ্চয় সংকীর্ণতা। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিত্যাগ করা আরও বড় মাত্রার হীনম্মন্যতা। আঞ্চলিক ভাষা টিকে থাকার একমাত্র উপায়টি হচ্ছে তার চর্চা অব্যাহত রাখা। লিপি না থাকার কারণে আঞ্চলিক ভাষা মুখে মুখে ব্যবহার বন্ধ হলে আঞ্চলিক ভাষা টিকতে পারবে না, লুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা রক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ হচ্ছে তার ব্যবহার সচল রাখা। অর্থাৎ মুখে মুখে থাকা সেই ভাষাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে বলা। আঞ্চলিক ভাষা বলা বন্ধ করলে আঞ্চলিক ভাষা যে লুপ্ত হওয়ার পথ ধরবে এটা তো খুবই সত্য কথা। আমরা চাইব মাতৃভাষার পাশাপাশি সব অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা স্বকীয়তায় টিকে থাকুক। মুখের এই ভাষার ব্যাপকভাবে সচল রাখার মাধ্যমেই আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। অভিভাবকরা নিজ নিজ সন্তানদের বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার সুযোগ দিয়ে আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করবে, সেটাই প্রত্যাশিত।
বিশ্বায়নের দৌরাত্ম্যে বিশ্বের সব জাতির ভাষা-সংস্কৃতি হুমকির কবলে। বিশ্বায়নের চাপে গরিব বিশ্বের চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার দশা। বিশ্বায়নের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতির দাপটে জাতিসত্তাগুলোর ভাষা-সংস্কৃতি দুর্দশাগ্রস্ত। বিশ্ব পুঁজিবাদ এক বিশ্বব্যবস্থায় এবং এক ভাষা-সংস্কৃতির সুযোগে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া বাজার সৃষ্টিতে যারপরনাই তৎপর। আমরা আমাদের ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই ভাষাও আজ চরম সংকটের কবলে। মাতৃভাষার পাশাপাশি দেশের সব লিপিবিহীন আঞ্চলিক ভাষা রক্ষা এখন আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার অনুরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের আশু কর্তব্য হবে মাতৃভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে রক্ষা করে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করা। সেটা সম্ভব না হলে আমরা সংকর প্রজাতির বিজাতীয় বনে যাব। সেটা যাতে না হয়, সে চেষ্টাই আমাদের করতে হবে বিশ্বায়ন নামক দৈত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে। সর্বোপরি মাতৃভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক প্রচারে।

- মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Post a Comment

0 Comments