সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা
ও খেলোয়াড় এদের মধ্যে কারা সমাজের জন্য বেশি কাজ করেন? কবিতা, গল্প,
উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ যারা লেখেন তারা কি সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিতে কোনো
চেষ্টা করেন না? এসব যদি কেউ না লিখে তখন কী হবে দেশের?
এ প্লাস ক্যাটাগরি ৪ লাখ টাকা।
এ ক্যাটাগরি ৩ লাখ টাকা।
বি ক্যাটাগরি ২ লাখ টাকা।
সি ক্যাটাগরি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
ডি ক্যাটাগরি ১ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বেতন পান ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রী বেতন পান ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
বিসিবির বর্তমান কেন্দ্রীয় চুক্তি অনুযায়ী শীর্ষ গ্রেডের ক্রিকেটারদের মাসিক বেতন ৪ লাখ টাকা।
এই গ্রেডে আছেন কেবল দেশের ৫ সিনিয়র ক্রিকেটার, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ।
‘এ’ গ্রেডে বেতন তিন লাখ টাকা। এখানে আছেন কেবল তিনজন- ইমরুল কায়েস, মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেন।
দুই লাখ টাকা পারিশ্রমিকের ‘বি’ ক্যাটেগরিতে আছেন মুমিনুল হক, মেহেদি হাসান মিরাজ, লিটন দাস ও তাইজুল ইসলাম। সাহিত্যকর্মীদের কি এমন কোনো ক্যাটাগরি আছে৷
এনিয়ে ভুক্তভোগী অথবা কবি সাহিত্যিকরাও কি নিজেদের পেশাদারিত্বের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে কখনও?
কবি-সাহিত্যিকরা বিনা সম্মানিতে পত্রিকায় লিখেন৷ প্রকাশককে পান্ডুলিপি দেন রয়ালটি ছাড়া৷ অনেক পত্রিকা ঈদ সংখ্যা বের করে লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন নিয়েও কবিতা গল্পের জন্য সম্মানী দেয়ার কোনো তাগিদ বোধ করেন না৷
বই মেলায় বই বের করে অধিকাংশ লেখকই প্রকাশকের কাছ থেকে কোনো প্রকার রয়ালটি পান না৷ খেলোয়াড় মরে গেলেই তার ক্রীড়া হারিয়ে যায়৷ কিন্তু সাহিত্য অনন্তকাল প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকে৷ কিন্তু এই কর্মটি আজও পেশাদার হয়ে উঠতে পারেনি৷ সাহিত্যিকরাও নির্বিকার, তাদের মাঝে এ নিয়ে কোনো তাগিদ নেই৷ যারা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তারা নিরাসক্তভাবে কেবল নিজের প্রাপ্তিতেই গদোগদো৷
সামষ্ঠিক উন্নতি নিয়ে কেউ ভাবছে না৷ কেউ বলছে না কবিতার জন্য সবাইকে এত, গল্পের জন্য এত, প্রবন্ধের জন্য এত ও উপন্যাসের জন্য এত সম্মানী দিতে হবে৷ এমন অপেশাদারিত্বের সাহিত্যবৈরী প্রতিকূলতায় সাহিত্যকর্মীরা হয়ে উঠছে পরিবার ও সমাজের কাছে অপাঙতেয়৷ তাদের এই অনিশ্চিত আর্থিক নিরাপত্তার কারণেই কোনো পরিবার তার সন্তানকে সাহিত্যিক হতে দিতে চায় না৷
কত কবির মাথা গুঁজার ঠাঁই নেই৷ নেই বেঁচে থাকার মতো নূন্যতম আর্থিক নিরাপত্তা৷ আবার অনেককে মরণোত্তর পুরস্কারের নামে দেখা যায় জীবিতদের সাহিত্যদরদী সাজার অভিনয় করে পুরস্কার কিংবা প্রশংসা ভাগিয়ে নিতে৷
এ পর্যন্ত মরণোত্তর পুরস্কার কয়জন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব পেয়েছেন আর কয়জন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব পেয়েছেন? যেখানে জীবদ্দশায় মূল্যায়নের ব্যাপার নেই সেখানে মরণোত্তর পুরস্কার মূল্যহীন নয় কি? ক্রীড়াবিদের ক্রীড়াকর্মের স্থায়িত্ব ও প্রভাব কতটা সমাজে আর সাহিত্যের কতটা? খেলোয়াড়ের খেলার শারীরিক যোগ্যতা হারিয়ে গেলে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে কেবল তার ব্যক্তি স্মৃতিচারণ ছাড়া কি তার কর্মের কোনো ধরনের দৃশ্যমান প্রবহমানতা থাকতে পারে? কিন্তু সাহিত্য? সাহিত্যিক সাহিত্য রচনার যোগ্যতা হারালে কিংবা মারা গেলেও কি তা হারায়? কবি নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন কিন্তু তার কবিতা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা জাগিয়েছে৷ তাকে আমরা জাতীয় কবি বলি কিন্তু আমাদের সংগ্রামমুখর জাতীয় জাগরণের সময় তিনি ছিলেন বাকরুদ্ধ৷ কিন্তু তার কবিতা ও গান ছিল সবাক ও তুমুল সরব৷
স্বদেশী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, নব্বইয়ের গণআন্দোলন প্রতিটি আন্দোলনেই ছিল সাহিত্যের সোচ্চার ভূমিকা৷ কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ক্রীড়ার কি অবদান? শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে সাহিত্য কি সে মেরুদণ্ডের হাড়, মাংস ও রক্ত নয়? এক্ষেত্রে ক্রীড়ার কী ভূমিকা? খেলোয়াড়দের জীবনযাপনের তুলনায় সাহিত্যিকদের জীবন কি ফকিরের মতো নয়? খেলোয়াড়রা যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পায় সাহিত্যিকরা কি তা পায়?
সাহিত্যিকদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্র, প্রকাশক, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, রয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলা একাডেমি৷ এক্ষেত্রে সাহিত্যের কোনো পৃথক মন্ত্রণালয় নেই কিন্তু ক্রীড়ার জন্য মন্ত্রণালয়ও রয়েছে৷ রয়েছে ক্রিকেট বোর্ড, ফুটবল ফেডারেশন, আবাহনী-মোহামেডানসহ আরো রয়েছে বিভিন্ন ক্লাব৷ এসব ক্লাব খেলোয়াড়দের পেশাদারিত্ব সৃষ্টির ভূমিকায় নিয়োজিত থাকে৷ কিন্ত সাহিত্যসেবী নানা সংগঠন, সংবাদপত্র, প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্যকর্মীদের পেশাদারিত্ব সৃষ্টিতে কি নূন্যতম কোনো ভূমিকা রেখেছে কখনও?
প্রকাশরা সাহিত্যিকদের রয়ালটি না দিয়ে উল্টো তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়৷ সংবাদপত্র সাহিত্যিকদের লেখা ছাপে কিন্তু তাদের সম্মানী দেয় না৷ বিনা রয়ালটিতে ও বিনা সম্মানীতে দিনের পর দিন তারা লিখে আর মানবেতর জীবনযাপন করে৷ এক্ষেত্রে সরকার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলা একাডেমি কি কোনো দায়িত্ব পালন করে?
জাতীয় কবিতা পরিষদও রয়েছে নীরব ভূমিকায়৷ তারা কবিদের পেশাদারিত্ব সৃষ্টির কোনো ভূমিকায় নেই৷ অথচ খেলোয়াড়রা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বেশি বেতন পেয়েও আন্দোলনে নামে৷ পেশাদারিত্ব ছাড়া কোন পেশা এগিয়ে যায়?
মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, ধর্মসভার বক্তা, মন্দিরের ঠাকুর, চার্চের পুরোহিত কে পেশাদার নয়? দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আখেরাতই (পরকাল) সব। ধর্মসভায় যিনি এমন বক্তব্য দিতে যান তিনিও ইহজগতবাসীদের সাথে আর্থিক চুক্তিটা আগে করেন পরে যান৷ কেবল পেশাদারিত্ব নেই সাহিত্যকর্মীদের৷ এনিয়ে সরকারেরও কোনো দৃষ্টি নেই৷ সাহিত্যিকরাও নির্বিকার যেন এটাই তাদের নিয়তি৷
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- এখলাসুর রহমান
0 Comments