বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একমাত্র পাটখাতই শতভাগ
মূল্য সংযোজনকারী, পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং একই
সঙ্গে বিশাল সংখ্যক নাগরিকের জীবন জীবিকার উৎস। এই পাটের ইতিহাস অনেক
পুরনো।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে লেখা মহাভারতে পাট বস্ত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে পাটের বা পাট পণ্যের
ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক স্বার্থে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাট
চাষ বন্ধ করা কিংবা পাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলে আসছে।
১৯৪০ সালে বঙ্গীয় কৃষি বিভাগের প্রচারপত্রে সতর্ক করা হয়েছিল যে, “চাহিদা বুঝে আবাদ করা এবার থেকে হবে, তাই তো আইন জারি হল, হুঁশিয়ার ভাই সবে।”
একই সময়ে মোট জমির এক তৃতীয়াংশের বেশী জমিতে পাট চাষ নিষিদ্ধ করা হয় নীল চাষ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।
এই ষড়যন্ত্র পাক আমল হয়ে এখনো বিদ্যমান। তাইতো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাট কেন্দ্রিক এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এই পাটখাতকে ছয় দফার অন্তর্ভূক্ত করেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করেন ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পিও ২৭ এর মাধ্যমে। কিন্তু প্রথম পাঁচসালা (৭৩-৭৮) ও পরবর্তীতে দুইসালা পরিকল্পনা (৭৯-৮০) শেষে ৮০’র দশক থেকে আবারো পাটশিল্পকে ধবংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৮২-৮৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচী বা Structural Adjustment Programme (SAP)-এর আওতায় অনেকগুলো মিল বিরাষ্ট্রীয়করণ করে মুনাফা অর্জনের সুখ স্বপ্ন দেখালেও ফলাফল আরো নাজুক হয়ে পড়ে। এই বাস্তব দৃষ্টান্ত সামনে থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার আবারো বিশ^ব্যাংকের পরামর্শে একই কর্মসূচি হাতে নেয়। এর নাম দেয় Jute Sector Adjustment Programme (JSAP)|JSAP-এর আওতায় ৯৩-৯৪ থেকে তিন বছর মেয়াদী Jute SectorReform Programme ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি Jute Sector Adjustment Credit-এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের চুক্তি হয়।
১২ এপ্রিল ১৯৯৪ এই প্রকল্পের একটি কর্মশালায় তৎকালীন পাট মন্ত্রী, বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এবং পাট সচিব রাষ্ট্রীয় পাটশিল্পের ‘স্থুল শরীরকে’ ‘এক হারা’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং ৬৯৭ কোটি ৩৭.৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে বিশ^ব্যাংক প্রতিনিধি নিম্নোক্ত কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
১. রাষ্ট্রীয় খাতের অবশিষ্ট ২৯টি মিলের মধ্যে ৯টি মিল বন্ধ এবং ২টি বৃহৎ মিলের তাঁত সংখ্যা হ্রাস করা।
২. মিলের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাকি ২০টির মধ্যে অন্ততঃ ১৮টি মিল ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া।
৩. মজুরী খরচ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা।
৪. উৎপাদন হার সুষম করার জন্য বিজেএমসি চালিত ১৫৮০০ তাঁত এর মধ্যে ১১৮০০ তাঁত বিলুপ্ত করা, এর ফলে মাত্র ৪০০০ তাঁত অবশিষ্ট থাকবে।
৫. ৯০০ মিলিয়ন ডলার বা তৎকালীন ৩৫০০ কোটি টাকার পুরাতন ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাস করে মিলের জন্য চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করা।
৬. ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের রিট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা।
৭. পাট খাতকে সরকারী হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা।
মূলত এই কর্মসূচীর মাধ্যমে পাটশিল্পের মৃত্যু ঘন্টা বেজে ওঠে। শিল্পঋণের নামে বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধবংস করে। সরকারী পাটখাতে লোকবল নিয়োগ বন্ধ করে বংশধরের অভাবে যেমন বংশ নির্বংশ হয় তদ্রুপ জনবলের অভাবেও বিজেএমসি তথা সরকারী পাটশিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আর যেসব মিল বিশ^ব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারীকরণ করা হয় তার সিংহভাগই আলোর মুখ দেখেনি। বরং এর মেশিনারি বিক্রি শেষে জায়গা নিয়েও ভিন্ন ব্যবসা করা হয়েছে।
পাট হচ্ছে বাংলাদেশের সোনার খনি। কিন্তু প্রকৃতি এই অঢেল সম্পদ যেমন আমাদের দিয়েছেন তেমনি দিয়েছেন সম্পদের রাজনীতি। ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত। তেল সমৃদ্ধ হয়েও যেমন তেল রাজনীতিতে অভিশপ্ত, পাটখনিও আমাদের জন্য তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
১৯৪৭-৪৮ সালে বিশে^র উৎপন্ন পাটের শতকরা ৮০.১৭ ভাগ বাংলাদেশে উৎপন্ন হত আর ঔপনিবেশিক চক্রান্তের ক্রমাগত ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। আপন মাংসই যেমন হরিণের আসল শত্রু তেমনি সরকারি পাটকলগুলোর যায়গা জমিই অনেক ক্ষেত্রে বিজেএমসির শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে। এ সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে অনেকের তাই তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে পাটকলগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে সম্পদ গ্রাসের অপচেষ্টায় লিপ্ত।
কথায় কথায় প্রশ্ন তুলে পাটে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে, অথচ এটা কিন্তু প্রাইমারি বিনিয়োগ, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। কেননা এ অর্থের মাধ্যমে পাটকলগুলো সচল থাকে, চাষীরা ন্যায্য মূল্য পায়, মেশিনারী প্রস্তুতকারী শিল্পগুলোও বেচে থাকে, ক্যারিং, হ্যান্ডলিং সহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় প্রাণচাঞ্চল্য পান। তাছাড়া পাট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্রান্ড। এই ব্রান্ড টিকিয়ে রাখতেও সরকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মাত্র ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাটের আঁশ পাওয়া যায়। এত কম সময়ে অন্য কোন প্রাকৃতিক তন্তু পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে পাট গাছ ১৫ টন কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১১ টন অক্সিজেন দেয়। এখনো প্রায় ৮ (আট) লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় বাংলাদেশে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এইযে অবদান তার জন্যও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে দিন দিন দেশে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। আমেরিকা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, যেমন তারা গম উৎপাদনে ভর্তুকি দেয় যাতে গম উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি বা সাহায্যের মাধ্যমে খাদ্য রাজনীতি করা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের বাজেট এখন লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার, তাহলে দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী যেখানে পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কোথায়?
বিশ্ব ব্যাংককে ভয় পেলে চলবে না। পদ্মা সেতুর মত সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বন্ধ পাটকলগুলো পুনঃ চালুর ব্যাপারে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের/দেশীয় সহযোগীদের চক্রান্তে বাংলাদেশে আদমজী বন্ধ হয় আর ভারতে আনন্দ হয় এবং নতুন পাটকল চালু হয়। ভারত বর্তমানে আমাদের চেয়ে বেশী পাট উৎপাদন করে অথচ রফতানি করে আমাদের চেয়ে কম কেননা তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ করে থাকে সিংহভাগ, অথচ আমাদের চিত্র পুরো উল্টা।
পাট বীজের প্রায় ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানী করতে হয়, আমাদের বীজ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও। এটা দেখা কার দায়িত্ব? এটাও কি বিজেএমসির ব্যর্থতা? অথচ এর ফলে আমরা দিন দিন দেশীয় উন্নত মানের কোয়ালিটি হারাচ্ছি। পাটের অপার সম্ভাবনা দেখেছিল বলেই বৃটিশরা ১৭৯১ সালেই পাটকল স্থাপনে গবেষণা শুরু করে আর আমরা তা বন্ধ/হ্রাস/বেসরকারিকরণের মধ্যেই সমাধান খুঁজছি।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পাটশিল্প নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করে। নিয়োগ দেওয়া হয় লোকবল, চালু করা হয় বন্ধ বেশ কয়েকটি মিল-কারখানা, কর্মসংস্থান হয় বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর, পাট চাষীরা ন্যায্য মূল্য পেয়ে পাট চাষে আগ্রহী হয়ে পাট চাষ বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাই বলে কি ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে আছে?
তারা বারবার চেষ্টা করেছে পাট শিল্পকে লোকসানী শিল্প হিসাবে চিহ্নিত করে পুরনো ধারায় তথা ধবংসের ধারায় ফিরে যেতে।
তুলনা করে হাতে গোণা দু’একটি বেসরকারী মিলের সঙ্গে। কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করেন না ঐ দু’একটি মিলের শ্রমিক মজুরী, চাকুরীর স্থায়ীত্ব, আনুতোষিক, অবসর ভাতা, অতিরিক্ত কর্মঘন্টা, সন্তানাদির শিক্ষা, আবাসন সুবিধা, ছুটির সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, লে-অফ সুবিধা ইত্যাদি নানারকম সরকারি সুবিধাসমূহ তাদের শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা পান কিনা? (২০১৩ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে ন্যুনতম মজুরী ও ভাতা হচ্ছে ৫১৫০ টাকা, পক্ষান্তরে ২০১০ সালের মজুরী স্কেল অনুযায়ী বিজেএমসির শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী ৯৮৬০ টাকা ও ২০১৫ সালের মজুরী স্কেল অনুযায়ী তা ১৯৫১৭ টাকা আর বিজেএমসির শ্রমিকদের অধিকাংশই ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অনেক উপরের স্কেলে মজুরী পেয়ে থাকে)।
মূলতঃ ঐ হাতে গোনা দু’একটি মিলও চালান বিজেএমসি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্তত তথা এখানকার সাবেক কর্মকর্তারা। তাহলে যারা সরকারি মিলে লাভ দেখাতে পারেননি তারা বেসরকারী মিলে ভাল করছেন কিভাবে?
খুবই সরল উত্তর হচ্ছে, কম মজুরী বা বেতন, চাকরি সুবিধা কর্তন, শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত তথা ১২ ঘন্টা কাজ করানো, রাজনীতিমুক্ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা এবং বাজার উন্নয়নে সক্ষমতা।
পক্ষান্তরে সরকার চায় তার শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তারা ভাল থাকুক, তাদের জীবন মান উন্নত হোক, পাট চাষীরা ন্যায্য মূল্য পাক ইত্যাদি কারণে সরকার তার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করে। তার ওপর সুবিধাবাদীদের অপ-রাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কলকারখানা বিষয়ে অনভিজ্ঞতার উপস্থিতি, বাজার উন্নয়নে অপেশাদার লোকদের সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত। এসব নানাবিধ কারণে বিজেএমসির উৎপাদন ব্যয় বেশি পক্ষান্তরে বিক্রি করতে হয় বেসরকারি/আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে। ফলে বিজেএমসি ব্যবসায়িক লস করে। আর বদনাম এসে পড়ে নিরীহ কর্মচারীদের ওপর।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিজেএমসি’র দুর্নীতির কথা বলে সত্যিকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
বারবার একই ভুলের চক্রে আমরা আবর্তিত হচ্ছিএ বংএকটা পর্যায়ে এমনও হতে পারে পাট চাষটা কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে পাট চাষটাই বাংলাদেশ থেকে উঠে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোরবানির গরুর চামড়া আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
২০০০ সালেও যখন চামড়ার সেন্ডেল পাওয়া যেত ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় তখন প্রতি চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আর এখন চামড়ার সেন্ডেলের মূল্য ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আর চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা। যেহেতু এখানে প্রতিযোগিতায় সরকার নেই তাই সাধারণের স্বার্থ দেখারও কেউ নেই।
দেশের মোট উৎপন্ন পাটের ২০ শতাংশ রফতানি হয়, ৫২ শতাংশ বেসরকারি মিল ব্যবহার করে আর প্রায় ১৫ শতাংশ বিজেএমসি ব্যবহার করলেও বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। এসব বিষয়সমূহ পাট প্রশাসনে যারা কাজ করেন তাদের ভাবনায় আসতে হবে।
দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যধি। বিজেএমসি এই সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয়। কিন্তু বিজেএমসির পোড় খাওয়া সাধারণ শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সিংহভাগই অসহায় এবং খুবই সাধারণ শ্রেণীর মানুষ। তিন-চার মাস বেতন না পেয়েও তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা দিয়ে নিয়মিত অফিস করে। এদের স্বার্থ রক্ষায় তথা এদেশের পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. বিজেএমসির শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যানুযায়ী বেসরকারি মিলের সঙ্গে মজুরী/বেতনের যে বাৎসরিক ব্যবধান তা আর্থিক বছরের শুরুতে মিলসমূহে/বিজেএমসিকে সরকার কর্তৃক প্রদান নিশ্চিত করা।
২. জাতীয় বাজেটে পাট খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং মিলসমূহের ও বিজেএমসির সকল শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকুরীউত্তর পাওনাদি সরকার তথা রাজস্ব খাত থেকে প্রদান নিশ্চিত করা অথবা পেনশন স্কীমের আওতায় নিয়ে আসা।
৩. অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া। ভারত সরকার এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারী অন্যান্য বিভাগে জিও জুট তথা পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে ইটঊঞ এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন স্যার এর প্রকাশনা ও ভারতের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
৪. পাটকলগুলোর পূর্বের গৃহীত সকল ঋণ সুদসহ মওকুফ করা এবং পাটক্রয়ে নিজস্ব তহবিল সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৫. দুর্নীতি বন্ধে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে ঢেলে সাজানো এবং নিরীক্ষা টিমকে চক্রাকারে দায়িত্ব দেয়া।
৬. বিজেএমসির বোর্ডকে আরো কার্যকর, মিলসমূহে আরো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পরিচালনা পর্ষদে সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ লোকদের পদায়ন নিশ্চিত করা।
৭. বিজেএমসির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আরো শক্তিশালী করা এবং বিজেএমসির মেকানিক্যাল টিমকে কার্যকর দক্ষ করে গড়ে তোলা।
৮. বাজার উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিশেষ করে বিদেশ সফরে ছোট ছোট টিমে বিভক্ত হয়ে নির্মোহভাবে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া।
৯. অনুকরণপ্রিয়তা তথা ওগঋ/বিশ্ব ব্যাংকের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে নিজ অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনায় ভয়, লোভ-অহংকার-ক্ষমতা ভুলে দুর্নীতিমুক্ত পাটপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করা।
সরকার নানা বিষয়েই দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করে থাকে, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য খাত, জ্বালানি খাত, শিক্ষা ইত্যাদি। পাট খাতেও সময়োপযোগী বিনিয়োগ প্রয়োজন যার রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। পাট খাত সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।
এটা একটা প্রকৃতি। একে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। এর পরিসর ছোট করা কিংবা একেবারে সরকারী পর্যায় থেকে ছেড়ে দেয়া কোনটাই সমাধান হতে পারে না বরং এর সুষ্ঠু পরিচর্যাই সমাধান হতে পারে। নিকট অতীত অন্তত তাই বলে।
- আবু তাবির, বিজেএমসি, ঢাকা
১৯৪০ সালে বঙ্গীয় কৃষি বিভাগের প্রচারপত্রে সতর্ক করা হয়েছিল যে, “চাহিদা বুঝে আবাদ করা এবার থেকে হবে, তাই তো আইন জারি হল, হুঁশিয়ার ভাই সবে।”
একই সময়ে মোট জমির এক তৃতীয়াংশের বেশী জমিতে পাট চাষ নিষিদ্ধ করা হয় নীল চাষ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।
এই ষড়যন্ত্র পাক আমল হয়ে এখনো বিদ্যমান। তাইতো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাট কেন্দ্রিক এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এই পাটখাতকে ছয় দফার অন্তর্ভূক্ত করেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করেন ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পিও ২৭ এর মাধ্যমে। কিন্তু প্রথম পাঁচসালা (৭৩-৭৮) ও পরবর্তীতে দুইসালা পরিকল্পনা (৭৯-৮০) শেষে ৮০’র দশক থেকে আবারো পাটশিল্পকে ধবংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৮২-৮৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচী বা Structural Adjustment Programme (SAP)-এর আওতায় অনেকগুলো মিল বিরাষ্ট্রীয়করণ করে মুনাফা অর্জনের সুখ স্বপ্ন দেখালেও ফলাফল আরো নাজুক হয়ে পড়ে। এই বাস্তব দৃষ্টান্ত সামনে থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার আবারো বিশ^ব্যাংকের পরামর্শে একই কর্মসূচি হাতে নেয়। এর নাম দেয় Jute Sector Adjustment Programme (JSAP)|JSAP-এর আওতায় ৯৩-৯৪ থেকে তিন বছর মেয়াদী Jute SectorReform Programme ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি Jute Sector Adjustment Credit-এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের চুক্তি হয়।
১২ এপ্রিল ১৯৯৪ এই প্রকল্পের একটি কর্মশালায় তৎকালীন পাট মন্ত্রী, বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এবং পাট সচিব রাষ্ট্রীয় পাটশিল্পের ‘স্থুল শরীরকে’ ‘এক হারা’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং ৬৯৭ কোটি ৩৭.৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে বিশ^ব্যাংক প্রতিনিধি নিম্নোক্ত কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
১. রাষ্ট্রীয় খাতের অবশিষ্ট ২৯টি মিলের মধ্যে ৯টি মিল বন্ধ এবং ২টি বৃহৎ মিলের তাঁত সংখ্যা হ্রাস করা।
২. মিলের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাকি ২০টির মধ্যে অন্ততঃ ১৮টি মিল ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া।
৩. মজুরী খরচ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা।
৪. উৎপাদন হার সুষম করার জন্য বিজেএমসি চালিত ১৫৮০০ তাঁত এর মধ্যে ১১৮০০ তাঁত বিলুপ্ত করা, এর ফলে মাত্র ৪০০০ তাঁত অবশিষ্ট থাকবে।
৫. ৯০০ মিলিয়ন ডলার বা তৎকালীন ৩৫০০ কোটি টাকার পুরাতন ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাস করে মিলের জন্য চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করা।
৬. ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের রিট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা।
৭. পাট খাতকে সরকারী হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা।
মূলত এই কর্মসূচীর মাধ্যমে পাটশিল্পের মৃত্যু ঘন্টা বেজে ওঠে। শিল্পঋণের নামে বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধবংস করে। সরকারী পাটখাতে লোকবল নিয়োগ বন্ধ করে বংশধরের অভাবে যেমন বংশ নির্বংশ হয় তদ্রুপ জনবলের অভাবেও বিজেএমসি তথা সরকারী পাটশিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আর যেসব মিল বিশ^ব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারীকরণ করা হয় তার সিংহভাগই আলোর মুখ দেখেনি। বরং এর মেশিনারি বিক্রি শেষে জায়গা নিয়েও ভিন্ন ব্যবসা করা হয়েছে।
পাট হচ্ছে বাংলাদেশের সোনার খনি। কিন্তু প্রকৃতি এই অঢেল সম্পদ যেমন আমাদের দিয়েছেন তেমনি দিয়েছেন সম্পদের রাজনীতি। ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত। তেল সমৃদ্ধ হয়েও যেমন তেল রাজনীতিতে অভিশপ্ত, পাটখনিও আমাদের জন্য তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
১৯৪৭-৪৮ সালে বিশে^র উৎপন্ন পাটের শতকরা ৮০.১৭ ভাগ বাংলাদেশে উৎপন্ন হত আর ঔপনিবেশিক চক্রান্তের ক্রমাগত ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। আপন মাংসই যেমন হরিণের আসল শত্রু তেমনি সরকারি পাটকলগুলোর যায়গা জমিই অনেক ক্ষেত্রে বিজেএমসির শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে। এ সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে অনেকের তাই তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে পাটকলগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে সম্পদ গ্রাসের অপচেষ্টায় লিপ্ত।
কথায় কথায় প্রশ্ন তুলে পাটে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে, অথচ এটা কিন্তু প্রাইমারি বিনিয়োগ, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। কেননা এ অর্থের মাধ্যমে পাটকলগুলো সচল থাকে, চাষীরা ন্যায্য মূল্য পায়, মেশিনারী প্রস্তুতকারী শিল্পগুলোও বেচে থাকে, ক্যারিং, হ্যান্ডলিং সহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় প্রাণচাঞ্চল্য পান। তাছাড়া পাট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্রান্ড। এই ব্রান্ড টিকিয়ে রাখতেও সরকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মাত্র ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাটের আঁশ পাওয়া যায়। এত কম সময়ে অন্য কোন প্রাকৃতিক তন্তু পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে পাট গাছ ১৫ টন কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১১ টন অক্সিজেন দেয়। এখনো প্রায় ৮ (আট) লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় বাংলাদেশে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এইযে অবদান তার জন্যও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে দিন দিন দেশে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। আমেরিকা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, যেমন তারা গম উৎপাদনে ভর্তুকি দেয় যাতে গম উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি বা সাহায্যের মাধ্যমে খাদ্য রাজনীতি করা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের বাজেট এখন লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার, তাহলে দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী যেখানে পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কোথায়?
বিশ্ব ব্যাংককে ভয় পেলে চলবে না। পদ্মা সেতুর মত সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বন্ধ পাটকলগুলো পুনঃ চালুর ব্যাপারে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের/দেশীয় সহযোগীদের চক্রান্তে বাংলাদেশে আদমজী বন্ধ হয় আর ভারতে আনন্দ হয় এবং নতুন পাটকল চালু হয়। ভারত বর্তমানে আমাদের চেয়ে বেশী পাট উৎপাদন করে অথচ রফতানি করে আমাদের চেয়ে কম কেননা তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ করে থাকে সিংহভাগ, অথচ আমাদের চিত্র পুরো উল্টা।
পাট বীজের প্রায় ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানী করতে হয়, আমাদের বীজ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও। এটা দেখা কার দায়িত্ব? এটাও কি বিজেএমসির ব্যর্থতা? অথচ এর ফলে আমরা দিন দিন দেশীয় উন্নত মানের কোয়ালিটি হারাচ্ছি। পাটের অপার সম্ভাবনা দেখেছিল বলেই বৃটিশরা ১৭৯১ সালেই পাটকল স্থাপনে গবেষণা শুরু করে আর আমরা তা বন্ধ/হ্রাস/বেসরকারিকরণের মধ্যেই সমাধান খুঁজছি।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পাটশিল্প নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করে। নিয়োগ দেওয়া হয় লোকবল, চালু করা হয় বন্ধ বেশ কয়েকটি মিল-কারখানা, কর্মসংস্থান হয় বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর, পাট চাষীরা ন্যায্য মূল্য পেয়ে পাট চাষে আগ্রহী হয়ে পাট চাষ বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাই বলে কি ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে আছে?
তারা বারবার চেষ্টা করেছে পাট শিল্পকে লোকসানী শিল্প হিসাবে চিহ্নিত করে পুরনো ধারায় তথা ধবংসের ধারায় ফিরে যেতে।
তুলনা করে হাতে গোণা দু’একটি বেসরকারী মিলের সঙ্গে। কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করেন না ঐ দু’একটি মিলের শ্রমিক মজুরী, চাকুরীর স্থায়ীত্ব, আনুতোষিক, অবসর ভাতা, অতিরিক্ত কর্মঘন্টা, সন্তানাদির শিক্ষা, আবাসন সুবিধা, ছুটির সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, লে-অফ সুবিধা ইত্যাদি নানারকম সরকারি সুবিধাসমূহ তাদের শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা পান কিনা? (২০১৩ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে ন্যুনতম মজুরী ও ভাতা হচ্ছে ৫১৫০ টাকা, পক্ষান্তরে ২০১০ সালের মজুরী স্কেল অনুযায়ী বিজেএমসির শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী ৯৮৬০ টাকা ও ২০১৫ সালের মজুরী স্কেল অনুযায়ী তা ১৯৫১৭ টাকা আর বিজেএমসির শ্রমিকদের অধিকাংশই ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অনেক উপরের স্কেলে মজুরী পেয়ে থাকে)।
মূলতঃ ঐ হাতে গোনা দু’একটি মিলও চালান বিজেএমসি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্তত তথা এখানকার সাবেক কর্মকর্তারা। তাহলে যারা সরকারি মিলে লাভ দেখাতে পারেননি তারা বেসরকারী মিলে ভাল করছেন কিভাবে?
খুবই সরল উত্তর হচ্ছে, কম মজুরী বা বেতন, চাকরি সুবিধা কর্তন, শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত তথা ১২ ঘন্টা কাজ করানো, রাজনীতিমুক্ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা এবং বাজার উন্নয়নে সক্ষমতা।
পক্ষান্তরে সরকার চায় তার শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তারা ভাল থাকুক, তাদের জীবন মান উন্নত হোক, পাট চাষীরা ন্যায্য মূল্য পাক ইত্যাদি কারণে সরকার তার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করে। তার ওপর সুবিধাবাদীদের অপ-রাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কলকারখানা বিষয়ে অনভিজ্ঞতার উপস্থিতি, বাজার উন্নয়নে অপেশাদার লোকদের সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত। এসব নানাবিধ কারণে বিজেএমসির উৎপাদন ব্যয় বেশি পক্ষান্তরে বিক্রি করতে হয় বেসরকারি/আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে। ফলে বিজেএমসি ব্যবসায়িক লস করে। আর বদনাম এসে পড়ে নিরীহ কর্মচারীদের ওপর।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিজেএমসি’র দুর্নীতির কথা বলে সত্যিকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
বারবার একই ভুলের চক্রে আমরা আবর্তিত হচ্ছিএ বংএকটা পর্যায়ে এমনও হতে পারে পাট চাষটা কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে পাট চাষটাই বাংলাদেশ থেকে উঠে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোরবানির গরুর চামড়া আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
২০০০ সালেও যখন চামড়ার সেন্ডেল পাওয়া যেত ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় তখন প্রতি চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আর এখন চামড়ার সেন্ডেলের মূল্য ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আর চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা। যেহেতু এখানে প্রতিযোগিতায় সরকার নেই তাই সাধারণের স্বার্থ দেখারও কেউ নেই।
দেশের মোট উৎপন্ন পাটের ২০ শতাংশ রফতানি হয়, ৫২ শতাংশ বেসরকারি মিল ব্যবহার করে আর প্রায় ১৫ শতাংশ বিজেএমসি ব্যবহার করলেও বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। এসব বিষয়সমূহ পাট প্রশাসনে যারা কাজ করেন তাদের ভাবনায় আসতে হবে।
দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যধি। বিজেএমসি এই সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয়। কিন্তু বিজেএমসির পোড় খাওয়া সাধারণ শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সিংহভাগই অসহায় এবং খুবই সাধারণ শ্রেণীর মানুষ। তিন-চার মাস বেতন না পেয়েও তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা দিয়ে নিয়মিত অফিস করে। এদের স্বার্থ রক্ষায় তথা এদেশের পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. বিজেএমসির শ্রমিক,কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যানুযায়ী বেসরকারি মিলের সঙ্গে মজুরী/বেতনের যে বাৎসরিক ব্যবধান তা আর্থিক বছরের শুরুতে মিলসমূহে/বিজেএমসিকে সরকার কর্তৃক প্রদান নিশ্চিত করা।
২. জাতীয় বাজেটে পাট খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং মিলসমূহের ও বিজেএমসির সকল শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকুরীউত্তর পাওনাদি সরকার তথা রাজস্ব খাত থেকে প্রদান নিশ্চিত করা অথবা পেনশন স্কীমের আওতায় নিয়ে আসা।
৩. অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া। ভারত সরকার এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারী অন্যান্য বিভাগে জিও জুট তথা পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে ইটঊঞ এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন স্যার এর প্রকাশনা ও ভারতের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
৪. পাটকলগুলোর পূর্বের গৃহীত সকল ঋণ সুদসহ মওকুফ করা এবং পাটক্রয়ে নিজস্ব তহবিল সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৫. দুর্নীতি বন্ধে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে ঢেলে সাজানো এবং নিরীক্ষা টিমকে চক্রাকারে দায়িত্ব দেয়া।
৬. বিজেএমসির বোর্ডকে আরো কার্যকর, মিলসমূহে আরো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পরিচালনা পর্ষদে সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ লোকদের পদায়ন নিশ্চিত করা।
৭. বিজেএমসির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আরো শক্তিশালী করা এবং বিজেএমসির মেকানিক্যাল টিমকে কার্যকর দক্ষ করে গড়ে তোলা।
৮. বাজার উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিশেষ করে বিদেশ সফরে ছোট ছোট টিমে বিভক্ত হয়ে নির্মোহভাবে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া।
৯. অনুকরণপ্রিয়তা তথা ওগঋ/বিশ্ব ব্যাংকের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে নিজ অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনায় ভয়, লোভ-অহংকার-ক্ষমতা ভুলে দুর্নীতিমুক্ত পাটপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করা।
সরকার নানা বিষয়েই দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করে থাকে, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য খাত, জ্বালানি খাত, শিক্ষা ইত্যাদি। পাট খাতেও সময়োপযোগী বিনিয়োগ প্রয়োজন যার রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। পাট খাত সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।
এটা একটা প্রকৃতি। একে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। এর পরিসর ছোট করা কিংবা একেবারে সরকারী পর্যায় থেকে ছেড়ে দেয়া কোনটাই সমাধান হতে পারে না বরং এর সুষ্ঠু পরিচর্যাই সমাধান হতে পারে। নিকট অতীত অন্তত তাই বলে।
- আবু তাবির, বিজেএমসি, ঢাকা
0 Comments