একটি রাষ্ট্র গঠনের পিছনে আন্দোলন, সংগ্রাম,
যুদ্ধবিগ্রহ, দখল, পুনঃ দখল, কূটনৈতিক চাল, ঈমানদারী, বেঈমানী, বিশ্বস্থতা,
বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতি জড়িত। বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র, কিন্তু এ ভূ-খন্ডটি
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্ন্তভুক্ত ছিল। নিজ ভূ-খন্ড থেকে
বিচ্ছিন্ন বা কখনো নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে অন্য ভ‚-খন্ডের সাথে সংযুক্ত
হওয়া রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে চলে আসছে। শক্তি
(চড়বিৎ) যার বেশি তার হাতেই বন্দি হয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব; নীতি, আদর্শ,
মানবতা এখানে বাতুলতা মাত্র। কিন্তু জাতি গঠনের বিষয়টি ভিন্নতর, যা একদিনে
সৃষ্টি হয় না বা হতে পারে না। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর
শতাব্দি অনুশীলনের মাধ্যমে যে সংস্কৃতি ও ভাবধারা এলাকাভিত্তিক গণমানুষের
মধ্যে গড়ে উঠে, তাই জাতিসত্তা। যুদ্ধবিগ্রহ বা আন্দোলন-সংগ্রাম বা
কূটকৌশলের মাধ্যমে ‘জাতির’ সৃষ্টি হয় না। একটি জাতি গঠন ও জাতিসত্তা একটি
জনগোষ্ঠির দীর্ঘদিন অনুশীলনের ফসল মাত্র। ভৌগোলিক ভাবধারা ও জলবায়ু
জাতিসত্তা গঠনে প্রভাব ফেলে, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনে জাতিসত্তার একটি ব্যাপক
প্রভাব রয়েছে।
রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু জাতি গঠিত হয় পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও আত্ম মর্যাদাবোধ থেকে। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতিসত্তার বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য ১৭৫৭, ১৯০৫, ১৯১১ এবং ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭০-৭১ সালসহ বর্তমান ভারতবর্ষের পরিমন্ডলকে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলা ভাষা বাঙালিদের একক ভাষা হলেও ভাষাটির প্রকারভেদ বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম। পার্বত্য এলাকার ভাষা প্রমীত বাংলা থেকে ভিন্নরূপ, যা সাধারণ একজন বাঙালির পক্ষে বোধগম্য হওয়া কষ্টকর। ভাষা ভিত্তিক পাহাড়ি, বাঙালি, নৃগোষ্ঠি এবং ধর্মভিত্তিক হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মিলেই বাংলাদেশ। জতিগত দ্ব›দ্ব পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও হয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমারে এবং যা শুরু হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে নিঃশেষ করার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় গণহত্যা, যার বীজ বপন হয় উওঝঈজওগওঘঅঞওঙঘ অর্থাৎ বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে।
ভারত উপমহাদেশের জাতিগত বৈষম্যের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, যা বর্ণনা ইতিহাসবিদদের লেখনীতে পাওয়া যায়। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রণীত ‘ভারত স্বাধীন হল’ বইতে তিনি লিখেছেন যে, ‘এই সময়ে আমি তখনকার একজন বাঘা বিপ্লবী কর্মী শ্রী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসি। ফলে আমি বিপ্লবী রাজনীতির দিকে ঝুঁকি ও ছোট ছোট উপদলের একটিতে ঢুকে পড়ি। সে সময় বিপ্লবী দলগুলোতে শুধু হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদেরই নেয়া হতো। সত্যি বলতে কী, বিপ্লবী দলগুলো তখন ছিল কায়মনোবাক্যে মুসলিম বিরোধী’ (সূত্র: ভারত স্বাধীন হল, পৃষ্ঠা ১২)। জওহর লাল নেহরুকে লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন। লেখকের অছিয়ত অনুযায়ী তার মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দ্বিজাতি তত্তে¡র পক্ষে কায়েদ আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের দাবি ছিল জোরদার। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ভ‚মিকা এক ও অভিন্ন। মিয়ানমার ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন একই সূত্রে গাঁথা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করার প্রশ্নে চীন এবং ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র বলে পরিচিত হলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কোনো প্রকার সহযোগিতা বা সমর্থন পায় নাই। তারপরও এ জটিল সমস্যার বোঝা বাংলাদেশকে একাই বইতে হচ্ছে, যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশের পাশে মুসলিম দেশগুলিই এগিয়ে এসেছে, ধর্ম নিরপেক্ষ বা মানবতার নামধারী ভেটো ক্ষমতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলি এগিয়ে আসে নাই। তবে কেউ কেউ শুধুমাত্র উদ্বেগ জানিয়েছে, যা শুধু ছিল লোক দেখানো মাত্র।
১৭৫৭ সালে তৎকালীন কতিপয় উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বেঈমানীর কারণে ৬৫ হাজার সৈন্য থাকা সত্তে¡ও নবাব সিরাজদৌল্লাহকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল বৃটিশের ৩,৫০০ সৈন্যের নিকট। সে দিন যদি বেঈমানী না হতো তবে ভারতবর্ষের ইতিহাস ভিন্নতর হতো। পৃথিবীতে ঈমানদারিত্বের চেয়ে বেঈমানীর ইতিহাস অনেক বড়, যার কালিমা থেকে ভারতবর্ষ বাদ পড়ে না।
জনসংখ্যার গুরুত্ব, শিক্ষা বিস্তারসহ গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য তৎকালীন মুসলিম নেতৃত্ব বিশেষ করে স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গণ দাবির মুখে বৃটিশ সরকার পূর্ববঙ্গ ও আসামকে যুক্ত করে ঢাকাকে রাজধানী করে ১৯০৫ সালে একটি প্রদেশ গঠন করে। কিন্তু ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এ প্রদেশ মেনে নেয় নাই। তাদের আন্দোলনের কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে পুনরায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম কোলকাতার অধীনে চলে যায়। ভারত স্বাধীনতা আইন-১৯৩৫ বৃটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদন হওয়ার পরই বৃটিশ থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বৃটিশরা সহজভাবে ভারতের স্বাধীনতা মেনে নেয় নাই। বৃটিশরা ভারতকে লুট করেছে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, স্যারসহ নানা ধরনের উপাধি দিয়ে বৃটিশরা ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করে, উবারফব ্ জঁষব নীতি অনুসরণ করে বৈষম্যের আনুষ্ঠানিক প্রচলন করে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, জনস্বার্থ বিরোধী একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ সরকার, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে (১৯৪৭ ও ১৯৭১) দু’বার, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতি বৃটিশের প্রভাবেই প্রভান্বিত। দেশপ্রেম ও মর্যাদাবোধ এখনো পরাধীনতার মানসিকতাজাত। ফলে পূর্বে এদেশ ও জাতি শোষিত হয়েছে বৃটিশ, পাকিস্তানী দ্বারা, এখন নিজেদের মধ্যেই শোষক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাসের পিছনে তাকালে দৃশ্যমান হয় যে, মোদী ও অমিতশাহর নেতৃত্বাধীন ভারতে এখন যা ঘটছে তা হলো দ্বিজাতি তত্তে¡র বাস্তবায়ন। মুসলিম লীগের উদ্যেগে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ঞড়ি ঘধঃরড়হ ঞযবড়ৎু অর্থাৎ দ্বিজাতি তত্ত¡ প্রাধান্য পায়। কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরেই হিন্দুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে দাবি উঠে ১৯০৮ সাল থেকেই। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ভারত থেকে বের করে দেয়ার যুক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িক গবেষক মি. বিনায়ক দামোদর সভারকার ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ বইটি প্রকাশ করেন। সে ধ্যান ধারণাকে লালন করে শুধুমাত্র মুসলিম নিধনের জন্য ভারতের এই এন.আর.সি উদ্যেগ। কেউ কেউ স্মৃতি ভুলে গেলেও অতীত তো ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে। ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কথা নয়, তবে অতীত থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে চায় না। স্মৃতি ভুলে যাওয়াকে একটি রোগ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ডিমেনশিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এ রোগীর সংখ্যা ১০ লক্ষ, ২০৫০ সালে পৃথিবীতে এ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ কোটিরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ অতীত ভুলে যায় স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়ার কারণে, কিন্তু মূল জন¯্রােতের কিন্তু ইতিহাস ভুলার কথা নয়। অতীতকে জানার সুযোগ মানুষের রয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতকে জানার বা দেখার সুযোগ নাই। কারণ, সৃষ্টিকর্তা জোর দিয়েই বলেছেন, গায়েবকে জানার জ্ঞানের একমাত্র মালিক তিনি, যিনি সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা। কোরানিক ভাষায় আলিমুল গায়েব। ভবিষ্যত সম্পর্কে কেউ যদি জানতো তবে কেউই বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতো না। বাংলাদেশে যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করেছে তাদের পরিণতি সুখকর হয় নাই। প্রতিহিংসাপরায়ন এবং প্রতিপক্ষকে অত্যাচার-নির্যাতনের মানসিকতাপূর্ণ এই সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ইতিহাস অত্যন্ত করুণ এবং নির্মম।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন দুইজন রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া)। ক্ষমতা হারিয়ে কারাবন্দি হয়েছেন দু’জন রাষ্ট্রপতি (এরশাদ ও মোশতাক)। একজন রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ কর্তৃক অপসারিত হওয়ার আশঙ্কায় পদত্যাগ করেছেন (বি চৌধুরী)। প্রভাবশালী দুই নারী প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি হয়েছেন, যার মধ্যে একজন এখনো কারাভোগ করছেন। প্রভাবশালী এমন কোনো মন্ত্রী নাই যিনি কারাভোগ করেন নাই। যারা ঠুঁটোজগন্নাথ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাদের কারাভোগ করতে হয় নাই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতা হারিয়ে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে পুলিশের পিটুনি খেয়েছেন (মো. নাসিম, মতিন চৌধুরী, আলতাফ চৌধুরী, বাবর)। গলাধাক্কা খেয়ে প্রধান বিচারপতি (এস.কে সিনহা) দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে দুদক মামলায় কারাগার তাকে ডাকছে, যদিও দুদককে তিনিই শক্তিশালী করে দিয়েছেন। তার মতে, রাজনীতিবিদরা সকলেই দুর্নীতিবাজ। যে রায় প্রদানের কারণে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেন সেই রায়ে সকল বিচারপতিগণ স্বাক্ষরদাতা হলেও সিনহাকে বাঁচানোর জন্য তার সহকর্মী বিচারপতিরা এগিয়ে আসেন নাই, বরং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এ দেশে ক্ষমতা ভোগীদের ভাগ্যোর নির্মম পরিহাস কখন কী হয় তা কেউ আঁচ করতে পারে না। ৩০ টাকার ইফতারী কখন কার ভাগ্যে জোটে তাও বলা যায় না। কখন কে কারাগারে রাজার হালে থাকে বা থাকবে তাও অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি নির্মম সত্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু লাশ যখন সিঁড়িতে পড়ে ছিল তখন দলের এতো নেতাকর্মী ছিল কোথায়? বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতিসত্তা লাইন চ্যুতি হয়ে কি খাদের কিনারে, নাকি নীড়হারা পাখির মতো শুধু উন্নয়নের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, নাকি পথের সন্ধান পেয়ে গন্তব্য স্থলের দিকে এগুচ্ছে, বিষয়গুলি ভাবনার খোরাক। ইট-সিমেন্টের উন্নয়ন দিয়ে জাতিসত্তার মর্যাদার মাপকাঠি নিরূপণ করা যায় না। উন্নয়ন কারো সমষ্টিগত মর্যাদা, সম্মানবোধ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা জমাটবদ্ধ করে না। বর্তমানে জিরো টলারেন্স নামক একটি কালচার আবিষ্কার হয়েছে, যা আদর্শিকভাবে প্রয়োগ না হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বর্তমান জাতিসত্তা শুধু ক্ষমতার পাশে থাকতে চায়, আদর্শের পক্ষে নয়, ব্যতিক্রম যা রয়েছে তা জন স্রোতের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যাদের গলার আওয়াজ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। ফলে সর্বত্রই চলে রাজার জয়গান। সত্য যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
লেখক:তৈমূর আলম খন্দকার, চেয়ারম্যান, গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলন
রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু জাতি গঠিত হয় পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও আত্ম মর্যাদাবোধ থেকে। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতিসত্তার বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য ১৭৫৭, ১৯০৫, ১৯১১ এবং ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭০-৭১ সালসহ বর্তমান ভারতবর্ষের পরিমন্ডলকে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলা ভাষা বাঙালিদের একক ভাষা হলেও ভাষাটির প্রকারভেদ বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম। পার্বত্য এলাকার ভাষা প্রমীত বাংলা থেকে ভিন্নরূপ, যা সাধারণ একজন বাঙালির পক্ষে বোধগম্য হওয়া কষ্টকর। ভাষা ভিত্তিক পাহাড়ি, বাঙালি, নৃগোষ্ঠি এবং ধর্মভিত্তিক হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মিলেই বাংলাদেশ। জতিগত দ্ব›দ্ব পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও হয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমারে এবং যা শুরু হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে নিঃশেষ করার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় গণহত্যা, যার বীজ বপন হয় উওঝঈজওগওঘঅঞওঙঘ অর্থাৎ বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে।
ভারত উপমহাদেশের জাতিগত বৈষম্যের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, যা বর্ণনা ইতিহাসবিদদের লেখনীতে পাওয়া যায়। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রণীত ‘ভারত স্বাধীন হল’ বইতে তিনি লিখেছেন যে, ‘এই সময়ে আমি তখনকার একজন বাঘা বিপ্লবী কর্মী শ্রী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসি। ফলে আমি বিপ্লবী রাজনীতির দিকে ঝুঁকি ও ছোট ছোট উপদলের একটিতে ঢুকে পড়ি। সে সময় বিপ্লবী দলগুলোতে শুধু হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদেরই নেয়া হতো। সত্যি বলতে কী, বিপ্লবী দলগুলো তখন ছিল কায়মনোবাক্যে মুসলিম বিরোধী’ (সূত্র: ভারত স্বাধীন হল, পৃষ্ঠা ১২)। জওহর লাল নেহরুকে লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন। লেখকের অছিয়ত অনুযায়ী তার মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দ্বিজাতি তত্তে¡র পক্ষে কায়েদ আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের দাবি ছিল জোরদার। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ভ‚মিকা এক ও অভিন্ন। মিয়ানমার ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন একই সূত্রে গাঁথা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করার প্রশ্নে চীন এবং ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র বলে পরিচিত হলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কোনো প্রকার সহযোগিতা বা সমর্থন পায় নাই। তারপরও এ জটিল সমস্যার বোঝা বাংলাদেশকে একাই বইতে হচ্ছে, যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশের পাশে মুসলিম দেশগুলিই এগিয়ে এসেছে, ধর্ম নিরপেক্ষ বা মানবতার নামধারী ভেটো ক্ষমতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলি এগিয়ে আসে নাই। তবে কেউ কেউ শুধুমাত্র উদ্বেগ জানিয়েছে, যা শুধু ছিল লোক দেখানো মাত্র।
১৭৫৭ সালে তৎকালীন কতিপয় উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বেঈমানীর কারণে ৬৫ হাজার সৈন্য থাকা সত্তে¡ও নবাব সিরাজদৌল্লাহকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল বৃটিশের ৩,৫০০ সৈন্যের নিকট। সে দিন যদি বেঈমানী না হতো তবে ভারতবর্ষের ইতিহাস ভিন্নতর হতো। পৃথিবীতে ঈমানদারিত্বের চেয়ে বেঈমানীর ইতিহাস অনেক বড়, যার কালিমা থেকে ভারতবর্ষ বাদ পড়ে না।
জনসংখ্যার গুরুত্ব, শিক্ষা বিস্তারসহ গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য তৎকালীন মুসলিম নেতৃত্ব বিশেষ করে স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গণ দাবির মুখে বৃটিশ সরকার পূর্ববঙ্গ ও আসামকে যুক্ত করে ঢাকাকে রাজধানী করে ১৯০৫ সালে একটি প্রদেশ গঠন করে। কিন্তু ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এ প্রদেশ মেনে নেয় নাই। তাদের আন্দোলনের কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে পুনরায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম কোলকাতার অধীনে চলে যায়। ভারত স্বাধীনতা আইন-১৯৩৫ বৃটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদন হওয়ার পরই বৃটিশ থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বৃটিশরা সহজভাবে ভারতের স্বাধীনতা মেনে নেয় নাই। বৃটিশরা ভারতকে লুট করেছে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, স্যারসহ নানা ধরনের উপাধি দিয়ে বৃটিশরা ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করে, উবারফব ্ জঁষব নীতি অনুসরণ করে বৈষম্যের আনুষ্ঠানিক প্রচলন করে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, জনস্বার্থ বিরোধী একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ সরকার, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে (১৯৪৭ ও ১৯৭১) দু’বার, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতি বৃটিশের প্রভাবেই প্রভান্বিত। দেশপ্রেম ও মর্যাদাবোধ এখনো পরাধীনতার মানসিকতাজাত। ফলে পূর্বে এদেশ ও জাতি শোষিত হয়েছে বৃটিশ, পাকিস্তানী দ্বারা, এখন নিজেদের মধ্যেই শোষক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাসের পিছনে তাকালে দৃশ্যমান হয় যে, মোদী ও অমিতশাহর নেতৃত্বাধীন ভারতে এখন যা ঘটছে তা হলো দ্বিজাতি তত্তে¡র বাস্তবায়ন। মুসলিম লীগের উদ্যেগে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ঞড়ি ঘধঃরড়হ ঞযবড়ৎু অর্থাৎ দ্বিজাতি তত্ত¡ প্রাধান্য পায়। কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরেই হিন্দুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে দাবি উঠে ১৯০৮ সাল থেকেই। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ভারত থেকে বের করে দেয়ার যুক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িক গবেষক মি. বিনায়ক দামোদর সভারকার ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ বইটি প্রকাশ করেন। সে ধ্যান ধারণাকে লালন করে শুধুমাত্র মুসলিম নিধনের জন্য ভারতের এই এন.আর.সি উদ্যেগ। কেউ কেউ স্মৃতি ভুলে গেলেও অতীত তো ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে। ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কথা নয়, তবে অতীত থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে চায় না। স্মৃতি ভুলে যাওয়াকে একটি রোগ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ডিমেনশিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এ রোগীর সংখ্যা ১০ লক্ষ, ২০৫০ সালে পৃথিবীতে এ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ কোটিরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ অতীত ভুলে যায় স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়ার কারণে, কিন্তু মূল জন¯্রােতের কিন্তু ইতিহাস ভুলার কথা নয়। অতীতকে জানার সুযোগ মানুষের রয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতকে জানার বা দেখার সুযোগ নাই। কারণ, সৃষ্টিকর্তা জোর দিয়েই বলেছেন, গায়েবকে জানার জ্ঞানের একমাত্র মালিক তিনি, যিনি সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা। কোরানিক ভাষায় আলিমুল গায়েব। ভবিষ্যত সম্পর্কে কেউ যদি জানতো তবে কেউই বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতো না। বাংলাদেশে যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করেছে তাদের পরিণতি সুখকর হয় নাই। প্রতিহিংসাপরায়ন এবং প্রতিপক্ষকে অত্যাচার-নির্যাতনের মানসিকতাপূর্ণ এই সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ইতিহাস অত্যন্ত করুণ এবং নির্মম।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন দুইজন রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া)। ক্ষমতা হারিয়ে কারাবন্দি হয়েছেন দু’জন রাষ্ট্রপতি (এরশাদ ও মোশতাক)। একজন রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ কর্তৃক অপসারিত হওয়ার আশঙ্কায় পদত্যাগ করেছেন (বি চৌধুরী)। প্রভাবশালী দুই নারী প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি হয়েছেন, যার মধ্যে একজন এখনো কারাভোগ করছেন। প্রভাবশালী এমন কোনো মন্ত্রী নাই যিনি কারাভোগ করেন নাই। যারা ঠুঁটোজগন্নাথ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাদের কারাভোগ করতে হয় নাই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতা হারিয়ে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে পুলিশের পিটুনি খেয়েছেন (মো. নাসিম, মতিন চৌধুরী, আলতাফ চৌধুরী, বাবর)। গলাধাক্কা খেয়ে প্রধান বিচারপতি (এস.কে সিনহা) দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে দুদক মামলায় কারাগার তাকে ডাকছে, যদিও দুদককে তিনিই শক্তিশালী করে দিয়েছেন। তার মতে, রাজনীতিবিদরা সকলেই দুর্নীতিবাজ। যে রায় প্রদানের কারণে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেন সেই রায়ে সকল বিচারপতিগণ স্বাক্ষরদাতা হলেও সিনহাকে বাঁচানোর জন্য তার সহকর্মী বিচারপতিরা এগিয়ে আসেন নাই, বরং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এ দেশে ক্ষমতা ভোগীদের ভাগ্যোর নির্মম পরিহাস কখন কী হয় তা কেউ আঁচ করতে পারে না। ৩০ টাকার ইফতারী কখন কার ভাগ্যে জোটে তাও বলা যায় না। কখন কে কারাগারে রাজার হালে থাকে বা থাকবে তাও অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি নির্মম সত্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু লাশ যখন সিঁড়িতে পড়ে ছিল তখন দলের এতো নেতাকর্মী ছিল কোথায়? বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতিসত্তা লাইন চ্যুতি হয়ে কি খাদের কিনারে, নাকি নীড়হারা পাখির মতো শুধু উন্নয়নের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, নাকি পথের সন্ধান পেয়ে গন্তব্য স্থলের দিকে এগুচ্ছে, বিষয়গুলি ভাবনার খোরাক। ইট-সিমেন্টের উন্নয়ন দিয়ে জাতিসত্তার মর্যাদার মাপকাঠি নিরূপণ করা যায় না। উন্নয়ন কারো সমষ্টিগত মর্যাদা, সম্মানবোধ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা জমাটবদ্ধ করে না। বর্তমানে জিরো টলারেন্স নামক একটি কালচার আবিষ্কার হয়েছে, যা আদর্শিকভাবে প্রয়োগ না হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বর্তমান জাতিসত্তা শুধু ক্ষমতার পাশে থাকতে চায়, আদর্শের পক্ষে নয়, ব্যতিক্রম যা রয়েছে তা জন স্রোতের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যাদের গলার আওয়াজ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। ফলে সর্বত্রই চলে রাজার জয়গান। সত্য যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
লেখক:তৈমূর আলম খন্দকার, চেয়ারম্যান, গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলন
0 Comments