ইতিকাফের নিয়ম

ইতিকাফ আরবি শব্দ ‘আকফ’ মূলধাতু থেকে নির্গত। এর অর্থ হচ্ছে অবস্থান করা। যে মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়, এমন মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। 
এর উদ্দেশ্য, মসজিদে বসে আল্লাহর আনুগত্য, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভের আকাঙ্ক্ষা, সওয়াব অর্জনের প্রত্যাশা এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশা করা। 
প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশক রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিতভাবে মসজিদে ইতিকাফ করতেন এবং সাহাবায়ে কিরামও ইতিকাফ করতেন। 
নবীজি ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, কখনো তা ছুটে গেলে ঈদের মাসে আদায় করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। 
এ আমল তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত কায়েম ছিল। নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণও এ নিয়ম পালন করেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) ইতিকাফের বিধিসম্মত সময় মাহে রমজানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু আগে থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা শেষ হয়ে যায়। 
ইতিকাফকারী পুরুষ ২০ রমজান আসরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছাবেন এবং কোণে একটি ঘরের মতো পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে অবস্থান নেবেন; এমনভাবে যেন প্রয়োজনে জামাতের সময় পর্দা খুলে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। 
এ স্থানে পানাহার ও শয়ন করবেন এবং বিনা প্রয়োজনে এখান থেকে বের হবেন না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বা ফরজ গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরিয়তের প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাজ প্রভৃতির জন্য বের হওয়া জায়েজ। জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগের জন্য পুরুষদের মসজিদে এবং নারীদের জন্য গৃহে অবস্থ্থান করাই ইতিকাফ। 
স্ত্রীলোকের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহ। ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন। বাড়ির নির্দিষ্ট স্থান না থাকলে যেকোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ইতিকাফ করবেন এবং ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবেন না। 
প্রত্যেক ইতিকাফকারী রোজাদারের আল্লাহর ইবাদত, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ-রোজা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, মোরাকাবা-মোশাহেদা ও তওবা-ইস্তেগফারে ব্যস্ত থাকা এবং পার্থিব বিষয়ে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা থেকে দূরে থাকা অত্যাবশ্যক।
ইতিকাফের প্রকারভেদ 
সুন্নত ইতিকাফ 
রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যে কোনো একজন ইতিকাফ করলে পুরো মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতিকাফ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতিকাফ না করে তবে মহল্লার সবার সুন্নত পরিত্যাগের গোনাহ হবে। (দুররে মুখতার: ২/৪৪০)। ২১ তারিখের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতিকাফের সময়। কারণ রাসুল (সা.) প্রত্যেক বছর এই দিনগুলোতেই ইতিকাফ করতেন। এ কারণে এটাকে সুন্নত ইতিকাফ বলা হয়।
ওয়াজিব ইতিকাফ 
মান্নতের ইতিকাফ ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মানৎ পূর্ণ করে।’ (সূরা হজ: ২৯) তাতে কোনো শর্ত থাকুক বা না থাকুক। যেমন- কেউ বললো, ‘আমার এই কাজ সমাধা হলে আমি ইতিকাফ করবো’, এতে যেমন ইতিকাফ ওয়াজিব হবে ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে- ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইতিকাফ করবো’, এ অবস্থাতেও ইতিকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১৩, দুররে মুখতার: ২/৪৪১) সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব।
নফল ইতিকাফ 
উপরোক্ত দুই প্রকার ইতিকাফ ছাড়া বাকি সব ইতিকাফ নফল। এ ইতিকাফ মানুষ যেকোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ চায় করতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। এমনকি যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল ইতিকাফের নিয়ত করা সুন্নত।
সর্বোত্তম ইতিকাফ
ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী, এরপর মসজিদে আকসা। এরপর জুম‘আ মসজিদ, এরপর যে মসজিদে বেশি মুসল্লি সালাত আদায় করে থাকে। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেন, ইতিকাফ সহীহ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সঙ্গে আদায় করা হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেনো মসজিদে হারামে ইতিকাফ আদায় করে। এটি সওয়াবের ও জামাআতের দিক থেকে সর্বোত্তম।
ইতিকাফের শর্ত
মুসলমান হওয়া, পাগল না হওয়া, বালেগ হওয়া, নিয়ত করা, ফরজ গোসলসহ হায়েজ নেফাছ থেকে পবিত্র হওয়া, রোজা রাখা। মসজিদে ইতিকাফ করা। ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে জামে মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে যে মসজিদে জামাআত সহকারে সালাত হয় না, সে মসজিদে ইতিকাফ জায়েজ নেই।

Post a Comment

0 Comments