আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলছে। আগে প্লাস্টিক
নির্মিত নির্ধারিত কিছু জিনিস আমরা ব্যবহার করতাম। এখন ঘরের বাসনপত্তর থেকে
আসবাবপত্র এবং ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প থেকে ফুলের টব পর্যন্ত নিত্য
প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হচ্ছে। আর দেশের বাইরে তো
ঘরবাড়িও প্লাস্টিক দিয়ে নির্মাণের প্রচলন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি কি
কখনো খেয়াল করেছেন যে, প্লাস্টিকের পণ্যের গায়ে বিভিন্ন সাঙ্কেতিক চিহ্ন
থাকে? লক্ষ করলে দেখতে পাবেন প্লাস্টিকের পণ্যের গায়ে ত্রিভুজ আকৃতির
সাঙ্কেতিক চিহ্ন। এবং সে চিহ্নগুলোর মাঝে অথবা আশেপাশে রয়েছে কিছু গাণিতিক
সংখ্যা ও কিছু ইংরেজি অক্ষর। প্লাস্টিকের ব্যবহারবিধি, তা কতটা টেকসই, এবং
কতটা পরিবেশ বান্ধব, ব্যবহার যোগ্যতার সময়সীমা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে দিক
নির্দেশনা ও সতর্কতার জন্যই মূলত চিহ্নগুলো ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে
প্লাস্টিক রিসাইক্লিং বা পুনঃব্যবহারের চিহ্নও বলা হয়ে থাকে। চলুন জেনে
নিই, প্লাস্টিকে ব্যবহৃত এসব সাঙ্কেতিক চিহ্ন, গাণিতিক সংখ্যা এবং ইংরেজি
অক্ষর ব্যবহারের রহস্য।
বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের নাম্বারগুলো Source: Orderhealth
প্রথম ক্যাটাগরি
এই
ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের একটি ত্রিভুজ আকৃতির সিম্বল
থাকে। এবং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে 1 সংখ্যাটি। সিম্বলের নিচেই লেখা থাকে
PETE অথবা PET
(Polyethylene Terephthalate)। এর মানে হলো, প্লাস্টিকটিতে টেরেফথালেট
পলিথিলিন পদার্থের প্রভাব রয়েছে। এই ধরনের প্লাস্টিক সাধারণত ব্যবহার করা
হয় পানি, পানীয় সোডা ও তেলের জন্য বোতল বা কন্টেইনার তৈরিতে। আমাদের দেশে
মিনারেল ওয়াটার এবং সমস্ত বেভারেজের বোতল এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিক দিয়েই
তৈরি। ব্যবহার শেষে এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করে তৈরি করা হয়
গালিচা, ব্যাগ, ছোট ছোট খেলনা ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ একে নিরাপদ
প্লাস্টিক মনে করলেও এ ধরনের প্লাস্টিক মূলত ব্যাকটেরিয়া বহন করে এবং ছড়াতে
থাকে। যদিও অজ্ঞতার কারণে এই ক্যাটাগরি প্লাস্টিকের বোতল আমরা দিনের পর
দিন পানি পান করার জন্য ব্যবহার করে থাকি।
এখানের সবক’টি বোতল প্রথম ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত; Source: Venngage
দ্বিতীয় ক্যাটাগরি
এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের ত্রিভুজ আকৃতিটির নিচেই লেখা থাকে HDPE
(High Density Polyethylene)। এর মানে হলো, প্লাস্টিকটিতে উচ্চ ঘন
পলিথিলিন পদার্থের প্রভাব রয়েছে এবং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে 2 সংখ্যাটি।
এই ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় শ্যাম্পুর বোতল, দুধের জগ, ঘর পরিষ্কারের
পাত্র, জুসের বোতল, খাদ্যশস্য রাখার বৈয়ম, ডিটারজেন্ট পাউডারের বৈয়ম,
মোটরের তেল রাখার গ্যালন, দই ও মাখনের কন্টেইনার ইত্যাদির জন্য। ব্যবহার
শেষে এই প্লাস্টিককে রিসাইক্লিং করে তৈরি করা হয় কলম, বেঞ্চ, টেবিল
ইত্যাদি। এই ধরনের প্লাস্টিক নিরাপদ। তবে বেশিদিন ব্যবহারের জন্য কোনো
প্লাস্টিকই নিরাপদ নয়।
সাধারণত এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিক দিয়ে শ্যাম্পুর বোতল, দুধের জগ ইত্যাদি তৈরি হয়; Source: CNET
তৃতীয় ক্যাটাগরি
এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের ত্রিভুজ আকৃতিটির নিচেই লেখা থাকে
V or PVC (Vinyl) এর মানে হলো, প্লাস্টিকটিতে পলিভিনাইল ক্লোরাইড পদার্থের প্রভাব রয়েছে। এবং রিসাইক্লিং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে
3
সংখ্যাটি। খাবার মোড়ানোর প্যাকেট, প্লাম্বিং পাইপ, ডিটারজেন্ট বোতল,
এটিএম কার্ড বা মেম্বারশিপ কার্ড, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ইত্যাদি তৈরি করতে
ব্যবহৃত হয় এই প্লাস্টিক। এ ক্যাটাগরির প্লাস্টিক অস্বাস্থ্যকর। গর্ভপাতের
মতো বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি করে এই প্লাস্টিক। এই
প্লাস্টিকে রয়েছে এমন জীবাণু, যা দীর্ঘমেয়াদী ঘুমন্ত ক্যান্সার, হাড়
ক্ষয় ও যকৃতের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্নভাবে এটি পরিবেশের ব্যাপক
ক্ষতি করে থাকে। তবুও এই প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।
চতুর্থ ক্যাটাগরি
এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের ত্রিভুজ আকৃতিটির নিচেই লেখা থাকে
LDPE (Low Density Polyethylene)। এর মানে হলো, প্লাস্টিকটিতে লঘু ঘনত্বের পলিথিলিন পদার্থের প্রভাব রয়েছে এবং রিসাইক্লিং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে
4
সংখ্যাটি। এই প্লাস্টিকের ব্যবহার পাওয়া যায় শপিং ব্যাগ, পোশাক, গালিচা,
হিমায়িত খাবার, রুটির ব্যাগ, ও খাবার মোড়ানোর পলিথিন ব্যাগে। রিসাইক্লিং
পদ্ধতি যদিও এই প্লাস্টিকটির বাছাই প্রক্রিয়ায় এখনও স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও
এটি নিরাপদ প্লাস্টিক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ছবিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলো চতুর্থ ক্যাটাগরির; Source: chemistryland.com
পঞ্চম ক্যাটাগরি
এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের ত্রিভুজ আকৃতিটির নিচেই লেখা থাকে
PP (Polypropylene)। এর মানে হলো, প্লাস্টিকটিতে পলিপ্রোপলিন পদার্থের প্রভাব রয়েছে এবং রিসাইক্লিং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে
5
সংখ্যাটি। এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় কেচাপের বোতল, সিরাপের বোতল, এবং
ঔষধের বোতল ইত্যাদিতে। নিরাপদ প্লাস্টিকগুলোর মধ্যে এই ক্যাটাগরির
প্লাস্টিক অন্যতম।
পঞ্চম ক্যাটাগরির প্লাস্টিকে তৈরি এই পণ্যগুলো Source: SKS Science Products
ষষ্ঠ ক্যাটাগরি
এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের গায়ে রিসাইক্লিংয়ের ত্রিভুজ আকৃতিটির নিচেই লেখা থাকে
PS (Polystyrene)। এর মানে এই ধরনের প্লাস্টিকে পলেস্টারিন পদার্থের প্রভাব রয়েছে এবং রিসাইক্লিং সিম্বলের মাঝেই লেখা থাকবে
6
সংখ্যাটি। রিসাইক্লিং করা বেশ কষ্টসাধ্য এই ক্যাটাগরির প্লাস্টিক। ফলে এটা
পরিবেশের খুবই ক্ষতি করে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও সৃষ্টি করে
থাকে। এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় ডিমের খাঁচা, প্লাস্টিকের তৈরি মগ,
কাপ, পিরিচ ইত্যাদিতে।
ষষ্ঠ ক্যাটাগরির প্লাস্টিকের তৈরি থালা বাসন; Source: ATOFINA
সপ্তম ক্যাটাগরি
এই
ক্যাটাগরির প্লাস্টিক উপরোল্লিখিত ক্যাটাগরিতে না পড়ার ফলে বিশেষজ্ঞরা এই
আলাদা ক্যাটাগরির সৃষ্টি করেছেন। এই প্লাস্টিক বিভিন্ন পদার্থের মিশ্রণের
মাধ্যমে তৈরি হয়, যা পলিকার্বনেটের অন্তর্ভুক্ত। রিসাইক্লিং সিম্বলের মাঝেই
লেখা থাকবে
7 সংখ্যাটি। সানগ্লাস, আইপড কেস, কম্পিউটারের ক্ষেত্রে নাইলন, এবং বুলেটপ্রুফ সামগ্রীতে ব্যবহার হয় এই প্লাস্টিক। এর মধ্যে বিষাক্ত
bisphenol-A (BPA) রয়েছে। এই প্লাস্টিকে
BPA–
থাকার কারণে এতে হরমোনের ব্যাধি, বন্ধ্যাত্ব, হাইপার অ্যাক্টিভিটি, প্রজনন
সমস্যা এবং স্বাস্থ্যগত অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কিত বিষয় ঘটতে পারে। তাই
এমন প্লাস্টিক এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
কোন সংখ্যার প্লাস্টিক এড়ানো উচিত
সবধরনের প্লাস্টিকই এড়িয়ে চলা উচিত। যেহেতু প্লাস্টিক সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন ৩, ৬ এবং ৭ সংখ্যার প্লাস্টিকগুলো এড়িয়ে চলা ভালো। আর ১, ২, ৪ এবং ৫ সংখ্যার প্লাস্টিকগুলো তুলনামূলক নিরাপদ বলে তারা মনে করেন।
যেভাবে শুরু
দ্য সোসাইটি অব দ্য প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি (
SPI)
অর্থাৎ প্লাস্টিক শিল্পের সোসাইটি ১৯৮৮ সালে এই কোডিং পদ্ধতি শুরু করে,
যাতে রিসাইক্লিং বা পুনঃব্যবহারের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিভিন্ন ধরনের
প্লাস্টিককে শ্রেণী বিভাজন করতে সহজ হয়। মূলত, ত্রিভূজের সংখ্যাগুলো
প্লাস্টিকের গ্রেড নির্দেশ করে। সব দেশে না থাকলেও বিভিন্ন দেশের প্লাস্টিক
ইন্ডাস্ট্রিতে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।
উল্লেখ্য
প্রতিটি
ক্যাটাগরির সম্ভাব্য কিছু পণ্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সরাসরি
উল্লেখিত পণ্যের সাথে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং সংখ্যা না মিলিয়ে বরং বাস্তবে
প্লাস্টিকের কোনো একটি পণ্য নিয়ে সেটাকে উল্লেখিত ক্রাইটেরিয়ার সাথে মিলালে
সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে। এই সাত ক্যাটাগরি প্লাস্টিকের পণ্যগুলো একবারই
ব্যবহার করা যাবে, অর্থাৎ ওয়ান টাইম ইউজের জন্য তৈরি এসব। এর বেশি যদি
ব্যবহার করা হয়, তবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের
প্লাস্টিকের পণ্যে খাওয়ানো ঠিক নয়। এর মধ্যে গরম জিনিস ভরলে বা প্লাস্টিকের
বোতলে বা প্লেট ভরে খাবার গরম করলে, প্লাস্টিকের বিষাক্ত পদার্থ খাবারের
মধ্যে চলে যেতে পারে, যা শরীরে গিয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। আর যে
প্লাস্টিকে এমন কোনো সিম্বল বা চিহ্ন নেই, বুঝে নিতে হবে সে প্লাস্টিক
পণ্যটি আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে তৈরি হয়নি এবং সেটি আরো বেশি
অনিরাপদ। প্লাস্টিক পণ্যের পরিবর্তে বিকল্প ব্যবহার হিসাবে কাঁচ, চীনামাটি ও
স্টেইনলেস স্টিলের বাসন বা পণ্য ব্যবহার করতে পারি।
0 Comments