ইংরেজি জার্নাল এবং ইজম নিয়ে যে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতার উৎপত্তি; এর
অর্থ কোনো কিছু প্রকাশ করা ও অনুশীলন বা চর্চা করা। এ হিসেবে কোনো কিছু
জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য যে চর্চা বা অনুশীলন তাই হলো সাংবাদিকতা। সংবাদ
সংস্থা, এজেন্সি, ব্যুরো, প্রচার মাধ্যম, মিডিয়া, সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক,
রিপোর্টার, প্রতিনিধি, সংবাদদাতা, কলমচি, কলামনিস্ট, ভাষ্যকার প্রভৃতি
পদ-পদবি আমাদের দেশের সাংবাদিকতারই অংশ। এ ছাড়া, কথক, রটনাকারী, নিন্দুক,
আড্ডাবাজ, ফোঁপরদালাল, গুপ্তচর, দূত, গোয়েন্দা, মিথ্যে খবর, ভুল খবর,
মঙ্গলবার্তা এসব শব্দবন্ধও সাংবাদিকতার সাথেই সম্পর্কিত।
অন্যদিকে স্কুপ করা, নাড়ী-নক্ষত্র টেনে বের করা, ফাঁস বা প্রকাশ করা, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া, জানাজানি হওয়া, কাকের মুখে খবর পাওয়া, বাতাসের আগে খবর ছোটা, চাঞ্চল্যকর, লোমহর্ষক, মুখরোচক, হাঁড়ির খবর, স্থানীয় সংবাদ বা মফস্বলসমাচার এসব হলো সাংবাদিকতার একেকটি বিশেষায়িত রূপ।
বিশ্বের সংবাদপত্রের ইতিহাস ৩৯৫ বছরের হলেও আমাদের এই উপমহাদেশের ইতিহাস ২৩৫ বছরের। এই অঞ্চল থেকে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি। আর বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্র ‘কোরান্টস’ প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড থেকে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে।
কোনোটি বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও ১৮১৬ থেকে ১৮১৮ সালের মধ্যে প্রকাশিত ‘বাংলা গেজেট’, রংপুরের কাকিনার ‘বিশ্ববার্তা’, ‘রংপুর বার্তাবহ’, ‘সমাচার দর্পণ’ বা ‘সংবাদ ভাস্কর’ আমাদের ভাষার আদি পত্রিকার মর্যাদা পেয়েছে। এসব আদি পত্রিকার সূতিকাগার খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, আমাদের এই ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট অঞ্চল বা অজপাড়াগাঁ থেকেই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের উদ্ভব ঘটেছে। প্রাচীন গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা একচ্ছত্র বলেই মূলত এর সাথে সংবাদ চর্চা কিংবা সাংবাদিকতার বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে একসাথেই জড়িত।
কাজেই এতদাঞ্চলে ইদানীং প্রভাবশালী মিডিয়া হাউজ অথবা কিছু উন্নাসিক লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিকের কাছে মফস্বল বা আঞ্চলিক পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা যতই অচ্ছুত হন না কেন; সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকতার বিশেষায়িত রূপের শেকড়টি কিন্তু গাঁও-গেরামের আদি নিবাসেই প্রোথিত।
বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি ও প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের গুরুত্বও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইলফোন, অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারে সাংবাদিকতার ধরন বা ধ্যান-ধারণাও পাল্টে দিয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। আগের জামানায় যেখানে মানুষ সত্য, সুন্দর বা শান্তির অন্বেষণে ছাপাখানাকেন্দ্রিক গণমাধ্যম সাংবাদিকতায় নাম লেখাতেন, এখন এই সময়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে স্যাটেলাইট টিভি, অনলাইন টিভি, এফএম রেডিও, কমিউনিটি ও সিটিজেন রেডিও এবং ব্যক্তিগত ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটার বা অপরাপর যোগাযোগ মাধ্যমে আপামর সাংবাদিকের নামটি যখন তখন যত্রতত্রই দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এমন আধুনিক শহুরে বা গ্রামীণ সাংবাদিকতা দেশ বা দেশের অধিবাসীদের ভিতরগত চেতনার জায়গাটিও আমূল পালটে দিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। নাগরিক সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে ফেসবুকের কল্যাণেই রাজন বা রাকিবের হত্যাকারীদের ধরে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে। মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা সূচকের শনৈঃ শনৈঃ ঊর্ধ্বগতিতে সাংবাদিকরাও যার যার জায়গা থেকে সুষম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৪ বছরে এসে এত সাফল্য ও অগ্রগতির আখ্যান কাব্যে নগর ও মফস্বল নামের বিভাজিত সাংবাদিকতার অনুদার গল্পে গ্রামের সাংবাদিকটি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছে কি না- তা এক গভীর প্রশ্নবোধক চিহ্ন বটে! সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকদের রাষ্ট্র নির্দেশিত তথাকথিত ওয়েজবোর্ড বা বেতন কাঠামোর রূপ রং দেখব কোথায়?
নাকি ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়’ কিংবা ‘আঞ্চলিক সাংবাদিকতার সমস্যা ও সম্ভাবনা’ নিয়ে নিরন্তর আলোচনার মধ্যেই মফস্বল সাংবাদিকের ভাগ্য রাজধানীকেন্দ্রিক হর্তাকর্তাদের ইচ্ছের পেন্ডুলামে দোল খাচ্ছে? আসলে বাস্তবতাটা এমনই যে, সংবাদ রাজ্যের নাগরিক পিতারা গ্রাম্য অনার্য বা হরিজন সাংবাদিকদের সাথে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সামন্তপ্রথাই চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ নিয়ে যদি একটা দেশ হয়, তবে কি সেই দেশের রাজধানীকেন্দ্রিক সংখ্যালঘু সাংবাদিকতাই গণমাধ্যমের মূল প্রবাহ হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে ৪৪ বছর ধরেই হচ্ছে তো তাই! চোখ কান সামান্য খোলা রাখলেই যা অনুধাবন করা যেতে পারে।
২.
আঞ্চলিক সাংবাদিকতার রয়েছে এক উল্লেখযোগ্য গৌরবময় ইতিহাস। দেশ বিনির্মাণে এখনো সে প্রবাহ চলছেই। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোরের ঝিকরগাছার মাগুরা গ্রামের শিশির কুমার ঘোষ নিজস্ব ছাপাখানায় দিনরাত শ্রম দিয়ে পাক্ষিক ‘অমৃত প্রবাহিনী’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই সময় ওই পত্রিকায় নীল বিদ্রোহ নিয়ে অগ্নিঝরা লেখনি প্রকাশ করতেন তিনি। যার ফলে অত্যাচারী নীলকরদের হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। আর সে পত্রিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহিত্যকর্ম প্রকাশের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, হিংসা, ঘৃণার বিরুদ্ধে এবং ভালোবাসা ও মানবীয় মুক্তির পক্ষে তাঁর কলম চালাতেন। অমৃত প্রবাহিনী বা ধূমকেতু কোনো শহুরে বা রাজধানীকেন্দ্রিক তথাকথিত রাজরাজরাদের পত্রিকা ছিল, এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
আমাদের কালে প্রথম আলোর রাজশাহীর আঞ্চলিক সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ যখন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পাঠককে ৯৫ বছর বয়সী পলান সরকারের বই পড়া আন্দোলনের অসাধারণ গল্প শোনান, তা রাজধানীর অভিজাত মিডিয়াপাড়ায়ও দুর্দান্ত আলোড়ন তোলে।
ঝিনাইদহের আসানসোল গ্রামের কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী ১৯৯৯ সালে ডারউইনের কৃত্রিম নির্বাচন পদ্ধতি মেনে উচ্চ ফলনশীল ও সুস্বাদু ধান আবিষ্কার করেন। যা বর্তমানে হরিধান নামে পরিচিত। যে হরিধানকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলে বর্ণনা করেছিলেন বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ওই এলাকার সাংবাদিক আসিফ ইকবালের বদৌলতে পত্রিকা ও টিভিতে উঠে আসে সেই ধান উদ্ভাবনের চমকপ্রদ কাহিনী। যথারীতি ঢাকার মিডিয়া হাউজগুলোতে হরিপদ কাপালীকে নিয়ে হরেক রকম সোরগোল সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাজধানীর মিডিয়া নিয়ন্ত্রকরা কজনা আঞ্চলিক সাংবাদিক সেই আসিফ ইকবালের নাম বলতে পারবেন?
সমাজে পুনর্বাসিত রাজাকারদের নিয়ে জনকণ্ঠে ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আঞ্চলিক সাংবাদিকরাই যে রিপোর্টগুলো তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। সম্প্রতি এক সিনিয়র মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে বিনা দোষে কারাভোগ করা সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের লেখনীর জন্যই আমরা জানতে পেরেছিলাম মুসা বিন শমসের তথা রাজাকার লুলা মুসার আসল কাহিনী। আঞ্চলিক রিপোর্টারদের তৈরি দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা সেসব রিপোর্টই এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘাতক-দালালদের বিচারকাজের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিলেটের এনটিভির আঞ্চলিক সাংবাদিক মঈনুল হক বুলবুলের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বিনা বিচারে ২২ বছর কারাভোগ করা নিরপরাধ ফজলু মিয়া যখন গেল অক্টোবরে জেল থেকে মুক্তি পান- সেই রিপোর্ট টেলিভিশনের পিক আওয়ারের প্রধান সংবাদ হয়। এ জন্য অবশ্য সাংবাদিক তাঁর মিডিয়া হাউজ থেকে আশানুরূপ প্রশংসায় ধন্য হন। কিন্তু দেশের সব আঞ্চলিক সাংবাদিকের কপালে কি এমন প্রশংসা জোটে?
খ্যাতিমান সাংবাদিক শাহ আলমগীর ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতের বন্ধুস্থানীয় একজন চারণ সাংবাদিক সৈয়দ নাজাত হোসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ খ্যাত ঢাকার একটি টেলিভিশনে শুরু থেকে ১০ বছর কাজ করে ২০১১ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। জিয়াউল হক নামের গরিব এক সাদা মনের মানুষ দই বিক্রি করা টাকায় এলাকার দরিদ্র ছাত্রদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করেন। এ খবর টেলিভিশনে উপস্থাপন করে আলোচনায় আসেন নাজাত হোসেন। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাবিতে জীবনক্ষয়ী উত্তাল কানসাটের ধারাবাহিক খবরও করেন তিনি। কিন্তু প্রায় একযুগ এক রকম বিনা পয়সায় বেগার খেটে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ ব্যর্থ হয়ে মনের দুঃখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। অথচ তাঁকে যদি যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হতো-তিনিও হতে পারতেন এ কালের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন।
এই সময়ে এসে আমরা অন্তরালের খবর খোঁজে ফেরা ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’ গ্রন্থের লেখক ও একুশে পদক পাওয়া চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনকে আর কেন পাই না? তার জবাব জানা থাকবার কথা কেবল ঢাকার মিডিয়া মোগলদেরই।
বলা হয়, সাংবাদপত্র বা গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ। সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠায়, দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ ও মানবাধিকার সংরক্ষণেও সাংবাদিকতার অশেষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজ যে কেবল রাজধানীর মেকি চাকচিক্য ও শানসৈকতপূর্ণ সমাজ নয়, তা কোনো সংবাদপ্রেমী অনুভব করবে? অথচ দেশের সব সেবা খাতের মতো সাংবাদিকতাও আজ নগরের ঘেরাটোপে অসহায় বন্দী। সেই বন্দিত্বের নানামুখী লাভ লোকসানের ফন্দিফিকির নামের করপোরেট গরাদে অসীম সম্ভাবনাময় মফস্বল সাংবাদিকতা আজও খুব বেশি অবহেলিত! অন্য ব্যবসার মতো সংবাদ সংস্থার মালিকানাটাও আজ পুঁজি পাহারা দেওয়ার অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় নেমেছে। আর সেই প্রহরায় কোটি গ্রামীণ মানুষকে ‘এডুকেট’ করবার প্রবণতার চেয়ে মুষ্টিমেয় অভিজাতদের ‘এন্টারটেইন’ করাতেই ফায়দা হয়তো বেশি! আমাদের মিডিয়া হাউসের এমন লক্ষ্যভ্রষ্টতায় দেশ বা সামগ্রিক মানুষের কী লাভ, তা কে জানে?
মফস্বল ও নগরকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার এই বিভেদ যত বাড়তে থাকবে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ততোটাই বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। তারপরও মিডিয়া হাউজ, আইকন সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতাদের পাশাপাশি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও এই বিভাজনের পথেই তাদের একপেশে অশুভ যাত্রা অব্যাহত রাখছে।
সম্প্রতি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মিডিয়ায় বলেছেন, সনদ ছাড়া সাংবাদিকতা নয়, সাংবাদিকতা পেশায় আসতে হলে পরীক্ষার মাধ্যমে সনদধারী হতে হবে। অপসাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও প্রকৃত সাংবাদিকদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতেই এমন সব উদ্যোগ নিচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। সারাদেশে কর্মরত সাংবাদিকদের সনদ প্রাপ্যতার যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকায় যাঁরা সাংবাদিকতা করবেন তাঁদের পরীক্ষার সিলেবাস ও শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি এক ধরনের হবে, আর ঢাকায় যাঁরা সাংবাদিকতা করবেন তাঁদের পরীক্ষার প্রশ্ন, সিলেবাস ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ প্রতিটি বিষয়ে ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু আমাদের কথা হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে একজন ব্যক্তি যখন কোনো প্রভাবশালী মিডিয়ার রাজশাহীর আঞ্চলিক সাংবাদিক হবেন এবং অখ্যাত কোনো কলেজ থেকে কেউ যদি স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশের পুরো টিভি বা পত্রিকার মধ্যে সর্বনিম্ন র্যাংকিংয়ে থাকা কোনো মিডিয়ার ঢাকা অফিসের স্টাফ রিপোর্টার হন এদের দুইজনের পরীক্ষার সিলেবাস বা শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি আসলে কিরূপে নিরুপণ করা হবে তা কেউ জানে না। সারা দেশেই বিগত কয়েক যুগ ধরেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কলেজে শিক্ষকরাই জেলা পর্যায়ে পত্রিকায় রিপোর্টিং করেন, তা প্রেস কাউন্সিলকে কে বোঝাবে? ঢাকার সাংবাদিক ও আঞ্চলিক সাংবাদিক এমন বিভাজনের পরীক্ষা দিয়ে আর যাই হোক প্রকৃত সাংবাদিক খোঁজার গুড়ে বালি হতে পারে!
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আরেকটি কথা বলেছেন, এখন আমরা কী দেখছি, পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণি পাস করে সাংবাদিকতায় আসছে। পানের দোকানদার, চায়ের দোকানিও এখন সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। ফেসবুক চালায় সেও মোটরসাইকেলের সামনে প্রেস লাগিয়ে ঘুরছে। রাস্তায় বের হলেই সাংবাদিক লেখা গাড়ির ছড়াছড়ি। আসলে তাদের বেশির ভাগই সাংবাদিক নয়, ভুয়া সাংবাদিক। এই ভুয়া সাংবাদিকদের কারণে সাধারণ মানুষ যেমন জিম্মি, ঠিক তেমনি প্রকৃত সাংবাদিক ও তাঁদের মহান পেশাটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এই কথাগুলো অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু এই অপসাংবাদিকতার দৈন্য সংস্কৃতি গড়ে তুলবার দায়িত্ব কাদের ছিল, সে কথা ভুলে গেলে চলবে কেন?
মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে দেশের সংবাদ মিডিয়া মোটা দাগে তিনভাগে বিভক্ত। কোনো কোনো হাউজ সরকারি ওয়েজবোর্ডের নিয়ম মেনে ঢাকার সাংবাদিকদের পাশাপাশি আঞ্চলিক সাংবাদিকদেরও নিয়োগপত্র এবং তাদের প্রাপ্য বেতন ভাতা দেয়। কেউ কেউ ছয় মাসের কথা বলে শুরু থেকে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত ‘কন্ট্রাকচুয়াল’ জব নামের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো সাংবাদিক ‘পুষে’ যান। শেষোক্তরা কোনো নিয়োগপত্র বা বেতন-ভাতার নামটিও মুখে আনেন না। উপরন্তু আজকাল শোনা যাচ্ছে, সর্ব নিম্নস্তরের টিভিওয়ালারাও নাকি ত্রৈমাসিক বা ষান্মাসিক ভিত্তিতে আঞ্চলিক সাংবাদিকদের কাছ থেকেই বরং মালকড়ির স্বাদ গ্রহণ করছেন। আশ্চর্য ও দুঃখজনক হলেও সত্যি স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমানে মিডিয়ার রমরমা বাজারের কালেও শেষোক্ত দলই ভারি। অর্থাৎ আঞ্চলিক সাংবাদিকরা বেতন ভাতা বা নিয়োগপত্র ছাড়াই দিনের পর দিন বেগার খেটে যান। মজাটা হলো, আমাদের ভূমি অফিস, গ্যাস অফিস, বিদ্যুৎ অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, বিচারালয় নানা ছলচাতুরিতে করাপশন প্র্যাকটিস করে এবং গণ্ডমুর্খ বা হলুদ সাংবাদিকদেরও কিছু প্রকাশ করবার ক্ষমতা থাকে বলেই সেসব দুর্নীতিবাজ আধিকারিকরা এসব সাংবাদিকদের পোষেন এবং এরাও সেই সুযোগের সমূহ সদ্ব্যবহার করেন। তাহলে সমাজ যেসব ভুয়া সাংবাদিকের কাছে জিম্মি বলা হচ্ছে, এই জিম্মিগিরিটা সৃষ্টি করবার আদি ও আসল দায় কার? রাজধানীর ধনিকশ্রেণির যেসব গণমাধ্যম অধিকর্তারা আঞ্চলিক সাংবাদিকদের স্রেফ কলুর বলুদ বা শ্রমদাস ঠাওরান, তাদের বোধহয় এমন অনার্য শ্রমিকের জাত বিচারের ধার না ধারলেও চলে! তাই আগে তো গাছের গোড়া মানে যেসব মিডিয়া হাউজ গণমাধ্যমের ওপর ভর করে নিজের আখের গোছাচ্ছেন, কিন্তু মফস্বলের কর্মীদের রুটি রোজগারের দিকে নজরই দিচ্ছে না, তাদের মানসিকতার নীতি ও বোধে জল ঢালুন, তারপর না হয় ঠগ বাছতে গা উজাড় করা যাবে!
দেশের প্রিন্ট মিডিয়া প্রথম আলো ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এনটিভির মতো গুটি কয়েক সংবাদমাধ্যমে জেলা বা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্টাফ রিপোর্টার বা সিনিয়র রিপোর্টার পদবির সাংবাদিক রয়েছেন। তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই ঢাকার সাংবাদিকদের মতোই সরকার ঘোষিত ওয়েজবোর্ড মেনে বেতন ও ভাতা প্রদান করা হয়। খুব স্বাভাবিক কারণেই সমাজে এসব মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের সুনামও আছে। কিন্তু এদের চেয়েও ধনবান মিডিয়া হাউজগুলো কেন আঞ্চলিক সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেয় না তা খতিয়ে দেখতে এই রাষ্ট্রে কোনোকালে কি কেউ আবির্ভূত হবেন না?
৩.
মফস্বলে কর্মরত একজন মানুষ যখন চাকরি না মনে করে, কেবল সমাজে ভালো কিছু করবার নেশায় সাংবাদিকতায় নাম লেখান, সেই তিনি নিশ্চয় পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, মানবিক, কঠোর পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী, সাহসী, কৌতুহলী, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষিপ্র, প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, ধৈর্যশীল, ভদ্র, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, রস ও সাহিত্যবোধ সম্পন্ন প্রভৃতি নানা গুণে গুনান্বিত হন। কিন্তু সেই মানুষটিকেও সমাজের চোর, ডাকাত, মাস্তান, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, খুনি, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, দখলদার, বাজে পলিটিশিয়ান ও অবৈধ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়ে যেতে হয়। কিন্তু তাঁর কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন কি তিনি পান? পরিবারের ভরণপোষণ করবার সাধ্য কি তাঁর থাকে?
কাজেই অন্য কারণগুলোর কথা নাইবা বলা হলো, কেবল এই একটিমাত্র কারণেই এখনকার অত্যাধুনিক যুগে এসেও মফস্বল সাংবাদিকতায় টাউট, বাটপার ও মূর্খদের জয়জয়কার। এদের পিআইবি বা এনআইএমসি চেনার দরকার পড়ে না। এদের গাজীউল হক রচিত ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমের আইন ও বিধিমালা’ বইটি পড়ে দেখারও দরকার পড়ে না। আর বর্তমানের টিভিমুখীতার যুগে সেই সাংবাদিকটি যদি হন টেলিভিশনের বুমধারী তবে তো আরো পোয়াবারো। যারা নিজেদের গা বাঁচিয়েই চলবেন এবং সামান্য কিছু প্রাপ্যতার বিনিময়েই সমাজ বিনাশকারীদের মনে খামোখা দুঃখ দিতেই যাবেন না! এমন সাংবাদিক দিয়েই টিভিওয়ালারাও তাদের আবদার মতো খবর পেয়ে যান। তাতে টিভিও জিন্দা থাকে, আবার নীতি বহির্ভূতরা সবাই মিলে বাঁচে। এ ব্যাপারে আমেরিকান জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক হান্টার এস. থমসন অনেক আগেই বলে গেছেন,
The TV business is uglier than most things. It is normally perceived as some kind of cruel and shallow money trench through the heart of the journalism industry, a long plastic hallway where thieves and pimps run free and good men die like dogs, for no good reason.
রাজধানীতে কর্মরত সাংবাদিকরা বিষয়ভিত্তিক বিট নিয়ে সংবাদ চর্চা করেন। কিন্তু একজন আদর্শ আঞ্চলিক সাংবাদিককে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো’ সব বিষয় নিয়েই কাজ করতে হয়।
অথচ ঢাকার রিপোর্টাররা মফস্বলে এলে আড়ালে আবডালে একজন সুশিক্ষিত জেলা পর্যায়ের সাংবাদিককেও ‘লোকাল’ বলে রেসিস্ট ধরনের গালাগাল পাড়েন। এমনতর মানসিকতা সৃষ্টির দায়ভারটা সবার আগে বর্তায় রাজধানীতে এসি রুমে বসে খবরদারি করা নাক সিটকানো সম্পাদক অধিকর্তাদের ওপরই। অথচ দেশের সংবাদ জগতের আইকন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন বলতেন, ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’। তাহলে গ্রামে বাস করে দেশ বিনির্মাণ করা আলোকিত প্রান্তিক মানুষদের সুখ-দুঃখের খবর পরিবেশনকারী একজন মহৎ, আদর্শবান ও ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিককে বাঁচাতে কি হৃদয়বান অভিজাত মিডিয়া মানবরা এগিয়ে আসবেন না? যাতে দেশ এগিয়ে যায়, জয় হয় গণমানুষের। বিজয়ের ৪৪ বছরে এসে আমাদের জরাগ্রস্ত সাংবাদিক মানসিকতার এইটুকু পরিবর্তন নিশ্চয় হতে পারে।
লেখক :
, সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
অন্যদিকে স্কুপ করা, নাড়ী-নক্ষত্র টেনে বের করা, ফাঁস বা প্রকাশ করা, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া, জানাজানি হওয়া, কাকের মুখে খবর পাওয়া, বাতাসের আগে খবর ছোটা, চাঞ্চল্যকর, লোমহর্ষক, মুখরোচক, হাঁড়ির খবর, স্থানীয় সংবাদ বা মফস্বলসমাচার এসব হলো সাংবাদিকতার একেকটি বিশেষায়িত রূপ।
বিশ্বের সংবাদপত্রের ইতিহাস ৩৯৫ বছরের হলেও আমাদের এই উপমহাদেশের ইতিহাস ২৩৫ বছরের। এই অঞ্চল থেকে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি। আর বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্র ‘কোরান্টস’ প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড থেকে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে।
কোনোটি বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও ১৮১৬ থেকে ১৮১৮ সালের মধ্যে প্রকাশিত ‘বাংলা গেজেট’, রংপুরের কাকিনার ‘বিশ্ববার্তা’, ‘রংপুর বার্তাবহ’, ‘সমাচার দর্পণ’ বা ‘সংবাদ ভাস্কর’ আমাদের ভাষার আদি পত্রিকার মর্যাদা পেয়েছে। এসব আদি পত্রিকার সূতিকাগার খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, আমাদের এই ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট অঞ্চল বা অজপাড়াগাঁ থেকেই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের উদ্ভব ঘটেছে। প্রাচীন গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা একচ্ছত্র বলেই মূলত এর সাথে সংবাদ চর্চা কিংবা সাংবাদিকতার বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে একসাথেই জড়িত।
কাজেই এতদাঞ্চলে ইদানীং প্রভাবশালী মিডিয়া হাউজ অথবা কিছু উন্নাসিক লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিকের কাছে মফস্বল বা আঞ্চলিক পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা যতই অচ্ছুত হন না কেন; সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকতার বিশেষায়িত রূপের শেকড়টি কিন্তু গাঁও-গেরামের আদি নিবাসেই প্রোথিত।
বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি ও প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের গুরুত্বও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইলফোন, অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারে সাংবাদিকতার ধরন বা ধ্যান-ধারণাও পাল্টে দিয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। আগের জামানায় যেখানে মানুষ সত্য, সুন্দর বা শান্তির অন্বেষণে ছাপাখানাকেন্দ্রিক গণমাধ্যম সাংবাদিকতায় নাম লেখাতেন, এখন এই সময়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে স্যাটেলাইট টিভি, অনলাইন টিভি, এফএম রেডিও, কমিউনিটি ও সিটিজেন রেডিও এবং ব্যক্তিগত ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটার বা অপরাপর যোগাযোগ মাধ্যমে আপামর সাংবাদিকের নামটি যখন তখন যত্রতত্রই দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এমন আধুনিক শহুরে বা গ্রামীণ সাংবাদিকতা দেশ বা দেশের অধিবাসীদের ভিতরগত চেতনার জায়গাটিও আমূল পালটে দিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। নাগরিক সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে ফেসবুকের কল্যাণেই রাজন বা রাকিবের হত্যাকারীদের ধরে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে। মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা সূচকের শনৈঃ শনৈঃ ঊর্ধ্বগতিতে সাংবাদিকরাও যার যার জায়গা থেকে সুষম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৪ বছরে এসে এত সাফল্য ও অগ্রগতির আখ্যান কাব্যে নগর ও মফস্বল নামের বিভাজিত সাংবাদিকতার অনুদার গল্পে গ্রামের সাংবাদিকটি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছে কি না- তা এক গভীর প্রশ্নবোধক চিহ্ন বটে! সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকদের রাষ্ট্র নির্দেশিত তথাকথিত ওয়েজবোর্ড বা বেতন কাঠামোর রূপ রং দেখব কোথায়?
নাকি ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়’ কিংবা ‘আঞ্চলিক সাংবাদিকতার সমস্যা ও সম্ভাবনা’ নিয়ে নিরন্তর আলোচনার মধ্যেই মফস্বল সাংবাদিকের ভাগ্য রাজধানীকেন্দ্রিক হর্তাকর্তাদের ইচ্ছের পেন্ডুলামে দোল খাচ্ছে? আসলে বাস্তবতাটা এমনই যে, সংবাদ রাজ্যের নাগরিক পিতারা গ্রাম্য অনার্য বা হরিজন সাংবাদিকদের সাথে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সামন্তপ্রথাই চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ নিয়ে যদি একটা দেশ হয়, তবে কি সেই দেশের রাজধানীকেন্দ্রিক সংখ্যালঘু সাংবাদিকতাই গণমাধ্যমের মূল প্রবাহ হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে ৪৪ বছর ধরেই হচ্ছে তো তাই! চোখ কান সামান্য খোলা রাখলেই যা অনুধাবন করা যেতে পারে।
২.
আঞ্চলিক সাংবাদিকতার রয়েছে এক উল্লেখযোগ্য গৌরবময় ইতিহাস। দেশ বিনির্মাণে এখনো সে প্রবাহ চলছেই। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোরের ঝিকরগাছার মাগুরা গ্রামের শিশির কুমার ঘোষ নিজস্ব ছাপাখানায় দিনরাত শ্রম দিয়ে পাক্ষিক ‘অমৃত প্রবাহিনী’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই সময় ওই পত্রিকায় নীল বিদ্রোহ নিয়ে অগ্নিঝরা লেখনি প্রকাশ করতেন তিনি। যার ফলে অত্যাচারী নীলকরদের হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। আর সে পত্রিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহিত্যকর্ম প্রকাশের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, হিংসা, ঘৃণার বিরুদ্ধে এবং ভালোবাসা ও মানবীয় মুক্তির পক্ষে তাঁর কলম চালাতেন। অমৃত প্রবাহিনী বা ধূমকেতু কোনো শহুরে বা রাজধানীকেন্দ্রিক তথাকথিত রাজরাজরাদের পত্রিকা ছিল, এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
আমাদের কালে প্রথম আলোর রাজশাহীর আঞ্চলিক সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ যখন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পাঠককে ৯৫ বছর বয়সী পলান সরকারের বই পড়া আন্দোলনের অসাধারণ গল্প শোনান, তা রাজধানীর অভিজাত মিডিয়াপাড়ায়ও দুর্দান্ত আলোড়ন তোলে।
ঝিনাইদহের আসানসোল গ্রামের কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী ১৯৯৯ সালে ডারউইনের কৃত্রিম নির্বাচন পদ্ধতি মেনে উচ্চ ফলনশীল ও সুস্বাদু ধান আবিষ্কার করেন। যা বর্তমানে হরিধান নামে পরিচিত। যে হরিধানকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলে বর্ণনা করেছিলেন বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ওই এলাকার সাংবাদিক আসিফ ইকবালের বদৌলতে পত্রিকা ও টিভিতে উঠে আসে সেই ধান উদ্ভাবনের চমকপ্রদ কাহিনী। যথারীতি ঢাকার মিডিয়া হাউজগুলোতে হরিপদ কাপালীকে নিয়ে হরেক রকম সোরগোল সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাজধানীর মিডিয়া নিয়ন্ত্রকরা কজনা আঞ্চলিক সাংবাদিক সেই আসিফ ইকবালের নাম বলতে পারবেন?
সমাজে পুনর্বাসিত রাজাকারদের নিয়ে জনকণ্ঠে ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আঞ্চলিক সাংবাদিকরাই যে রিপোর্টগুলো তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। সম্প্রতি এক সিনিয়র মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে বিনা দোষে কারাভোগ করা সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের লেখনীর জন্যই আমরা জানতে পেরেছিলাম মুসা বিন শমসের তথা রাজাকার লুলা মুসার আসল কাহিনী। আঞ্চলিক রিপোর্টারদের তৈরি দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা সেসব রিপোর্টই এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘাতক-দালালদের বিচারকাজের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিলেটের এনটিভির আঞ্চলিক সাংবাদিক মঈনুল হক বুলবুলের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বিনা বিচারে ২২ বছর কারাভোগ করা নিরপরাধ ফজলু মিয়া যখন গেল অক্টোবরে জেল থেকে মুক্তি পান- সেই রিপোর্ট টেলিভিশনের পিক আওয়ারের প্রধান সংবাদ হয়। এ জন্য অবশ্য সাংবাদিক তাঁর মিডিয়া হাউজ থেকে আশানুরূপ প্রশংসায় ধন্য হন। কিন্তু দেশের সব আঞ্চলিক সাংবাদিকের কপালে কি এমন প্রশংসা জোটে?
খ্যাতিমান সাংবাদিক শাহ আলমগীর ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতের বন্ধুস্থানীয় একজন চারণ সাংবাদিক সৈয়দ নাজাত হোসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ খ্যাত ঢাকার একটি টেলিভিশনে শুরু থেকে ১০ বছর কাজ করে ২০১১ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। জিয়াউল হক নামের গরিব এক সাদা মনের মানুষ দই বিক্রি করা টাকায় এলাকার দরিদ্র ছাত্রদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করেন। এ খবর টেলিভিশনে উপস্থাপন করে আলোচনায় আসেন নাজাত হোসেন। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাবিতে জীবনক্ষয়ী উত্তাল কানসাটের ধারাবাহিক খবরও করেন তিনি। কিন্তু প্রায় একযুগ এক রকম বিনা পয়সায় বেগার খেটে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ ব্যর্থ হয়ে মনের দুঃখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। অথচ তাঁকে যদি যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হতো-তিনিও হতে পারতেন এ কালের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন।
এই সময়ে এসে আমরা অন্তরালের খবর খোঁজে ফেরা ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’ গ্রন্থের লেখক ও একুশে পদক পাওয়া চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনকে আর কেন পাই না? তার জবাব জানা থাকবার কথা কেবল ঢাকার মিডিয়া মোগলদেরই।
বলা হয়, সাংবাদপত্র বা গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ। সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠায়, দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ ও মানবাধিকার সংরক্ষণেও সাংবাদিকতার অশেষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজ যে কেবল রাজধানীর মেকি চাকচিক্য ও শানসৈকতপূর্ণ সমাজ নয়, তা কোনো সংবাদপ্রেমী অনুভব করবে? অথচ দেশের সব সেবা খাতের মতো সাংবাদিকতাও আজ নগরের ঘেরাটোপে অসহায় বন্দী। সেই বন্দিত্বের নানামুখী লাভ লোকসানের ফন্দিফিকির নামের করপোরেট গরাদে অসীম সম্ভাবনাময় মফস্বল সাংবাদিকতা আজও খুব বেশি অবহেলিত! অন্য ব্যবসার মতো সংবাদ সংস্থার মালিকানাটাও আজ পুঁজি পাহারা দেওয়ার অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় নেমেছে। আর সেই প্রহরায় কোটি গ্রামীণ মানুষকে ‘এডুকেট’ করবার প্রবণতার চেয়ে মুষ্টিমেয় অভিজাতদের ‘এন্টারটেইন’ করাতেই ফায়দা হয়তো বেশি! আমাদের মিডিয়া হাউসের এমন লক্ষ্যভ্রষ্টতায় দেশ বা সামগ্রিক মানুষের কী লাভ, তা কে জানে?
মফস্বল ও নগরকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার এই বিভেদ যত বাড়তে থাকবে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ততোটাই বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। তারপরও মিডিয়া হাউজ, আইকন সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতাদের পাশাপাশি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও এই বিভাজনের পথেই তাদের একপেশে অশুভ যাত্রা অব্যাহত রাখছে।
সম্প্রতি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মিডিয়ায় বলেছেন, সনদ ছাড়া সাংবাদিকতা নয়, সাংবাদিকতা পেশায় আসতে হলে পরীক্ষার মাধ্যমে সনদধারী হতে হবে। অপসাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও প্রকৃত সাংবাদিকদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতেই এমন সব উদ্যোগ নিচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। সারাদেশে কর্মরত সাংবাদিকদের সনদ প্রাপ্যতার যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকায় যাঁরা সাংবাদিকতা করবেন তাঁদের পরীক্ষার সিলেবাস ও শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি এক ধরনের হবে, আর ঢাকায় যাঁরা সাংবাদিকতা করবেন তাঁদের পরীক্ষার প্রশ্ন, সিলেবাস ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ প্রতিটি বিষয়ে ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু আমাদের কথা হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে একজন ব্যক্তি যখন কোনো প্রভাবশালী মিডিয়ার রাজশাহীর আঞ্চলিক সাংবাদিক হবেন এবং অখ্যাত কোনো কলেজ থেকে কেউ যদি স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশের পুরো টিভি বা পত্রিকার মধ্যে সর্বনিম্ন র্যাংকিংয়ে থাকা কোনো মিডিয়ার ঢাকা অফিসের স্টাফ রিপোর্টার হন এদের দুইজনের পরীক্ষার সিলেবাস বা শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি আসলে কিরূপে নিরুপণ করা হবে তা কেউ জানে না। সারা দেশেই বিগত কয়েক যুগ ধরেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কলেজে শিক্ষকরাই জেলা পর্যায়ে পত্রিকায় রিপোর্টিং করেন, তা প্রেস কাউন্সিলকে কে বোঝাবে? ঢাকার সাংবাদিক ও আঞ্চলিক সাংবাদিক এমন বিভাজনের পরীক্ষা দিয়ে আর যাই হোক প্রকৃত সাংবাদিক খোঁজার গুড়ে বালি হতে পারে!
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আরেকটি কথা বলেছেন, এখন আমরা কী দেখছি, পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণি পাস করে সাংবাদিকতায় আসছে। পানের দোকানদার, চায়ের দোকানিও এখন সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। ফেসবুক চালায় সেও মোটরসাইকেলের সামনে প্রেস লাগিয়ে ঘুরছে। রাস্তায় বের হলেই সাংবাদিক লেখা গাড়ির ছড়াছড়ি। আসলে তাদের বেশির ভাগই সাংবাদিক নয়, ভুয়া সাংবাদিক। এই ভুয়া সাংবাদিকদের কারণে সাধারণ মানুষ যেমন জিম্মি, ঠিক তেমনি প্রকৃত সাংবাদিক ও তাঁদের মহান পেশাটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এই কথাগুলো অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু এই অপসাংবাদিকতার দৈন্য সংস্কৃতি গড়ে তুলবার দায়িত্ব কাদের ছিল, সে কথা ভুলে গেলে চলবে কেন?
মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে দেশের সংবাদ মিডিয়া মোটা দাগে তিনভাগে বিভক্ত। কোনো কোনো হাউজ সরকারি ওয়েজবোর্ডের নিয়ম মেনে ঢাকার সাংবাদিকদের পাশাপাশি আঞ্চলিক সাংবাদিকদেরও নিয়োগপত্র এবং তাদের প্রাপ্য বেতন ভাতা দেয়। কেউ কেউ ছয় মাসের কথা বলে শুরু থেকে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত ‘কন্ট্রাকচুয়াল’ জব নামের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো সাংবাদিক ‘পুষে’ যান। শেষোক্তরা কোনো নিয়োগপত্র বা বেতন-ভাতার নামটিও মুখে আনেন না। উপরন্তু আজকাল শোনা যাচ্ছে, সর্ব নিম্নস্তরের টিভিওয়ালারাও নাকি ত্রৈমাসিক বা ষান্মাসিক ভিত্তিতে আঞ্চলিক সাংবাদিকদের কাছ থেকেই বরং মালকড়ির স্বাদ গ্রহণ করছেন। আশ্চর্য ও দুঃখজনক হলেও সত্যি স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমানে মিডিয়ার রমরমা বাজারের কালেও শেষোক্ত দলই ভারি। অর্থাৎ আঞ্চলিক সাংবাদিকরা বেতন ভাতা বা নিয়োগপত্র ছাড়াই দিনের পর দিন বেগার খেটে যান। মজাটা হলো, আমাদের ভূমি অফিস, গ্যাস অফিস, বিদ্যুৎ অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, বিচারালয় নানা ছলচাতুরিতে করাপশন প্র্যাকটিস করে এবং গণ্ডমুর্খ বা হলুদ সাংবাদিকদেরও কিছু প্রকাশ করবার ক্ষমতা থাকে বলেই সেসব দুর্নীতিবাজ আধিকারিকরা এসব সাংবাদিকদের পোষেন এবং এরাও সেই সুযোগের সমূহ সদ্ব্যবহার করেন। তাহলে সমাজ যেসব ভুয়া সাংবাদিকের কাছে জিম্মি বলা হচ্ছে, এই জিম্মিগিরিটা সৃষ্টি করবার আদি ও আসল দায় কার? রাজধানীর ধনিকশ্রেণির যেসব গণমাধ্যম অধিকর্তারা আঞ্চলিক সাংবাদিকদের স্রেফ কলুর বলুদ বা শ্রমদাস ঠাওরান, তাদের বোধহয় এমন অনার্য শ্রমিকের জাত বিচারের ধার না ধারলেও চলে! তাই আগে তো গাছের গোড়া মানে যেসব মিডিয়া হাউজ গণমাধ্যমের ওপর ভর করে নিজের আখের গোছাচ্ছেন, কিন্তু মফস্বলের কর্মীদের রুটি রোজগারের দিকে নজরই দিচ্ছে না, তাদের মানসিকতার নীতি ও বোধে জল ঢালুন, তারপর না হয় ঠগ বাছতে গা উজাড় করা যাবে!
দেশের প্রিন্ট মিডিয়া প্রথম আলো ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এনটিভির মতো গুটি কয়েক সংবাদমাধ্যমে জেলা বা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্টাফ রিপোর্টার বা সিনিয়র রিপোর্টার পদবির সাংবাদিক রয়েছেন। তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই ঢাকার সাংবাদিকদের মতোই সরকার ঘোষিত ওয়েজবোর্ড মেনে বেতন ও ভাতা প্রদান করা হয়। খুব স্বাভাবিক কারণেই সমাজে এসব মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের সুনামও আছে। কিন্তু এদের চেয়েও ধনবান মিডিয়া হাউজগুলো কেন আঞ্চলিক সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেয় না তা খতিয়ে দেখতে এই রাষ্ট্রে কোনোকালে কি কেউ আবির্ভূত হবেন না?
৩.
মফস্বলে কর্মরত একজন মানুষ যখন চাকরি না মনে করে, কেবল সমাজে ভালো কিছু করবার নেশায় সাংবাদিকতায় নাম লেখান, সেই তিনি নিশ্চয় পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, মানবিক, কঠোর পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী, সাহসী, কৌতুহলী, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষিপ্র, প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, ধৈর্যশীল, ভদ্র, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, রস ও সাহিত্যবোধ সম্পন্ন প্রভৃতি নানা গুণে গুনান্বিত হন। কিন্তু সেই মানুষটিকেও সমাজের চোর, ডাকাত, মাস্তান, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, খুনি, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, দখলদার, বাজে পলিটিশিয়ান ও অবৈধ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়ে যেতে হয়। কিন্তু তাঁর কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন কি তিনি পান? পরিবারের ভরণপোষণ করবার সাধ্য কি তাঁর থাকে?
কাজেই অন্য কারণগুলোর কথা নাইবা বলা হলো, কেবল এই একটিমাত্র কারণেই এখনকার অত্যাধুনিক যুগে এসেও মফস্বল সাংবাদিকতায় টাউট, বাটপার ও মূর্খদের জয়জয়কার। এদের পিআইবি বা এনআইএমসি চেনার দরকার পড়ে না। এদের গাজীউল হক রচিত ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমের আইন ও বিধিমালা’ বইটি পড়ে দেখারও দরকার পড়ে না। আর বর্তমানের টিভিমুখীতার যুগে সেই সাংবাদিকটি যদি হন টেলিভিশনের বুমধারী তবে তো আরো পোয়াবারো। যারা নিজেদের গা বাঁচিয়েই চলবেন এবং সামান্য কিছু প্রাপ্যতার বিনিময়েই সমাজ বিনাশকারীদের মনে খামোখা দুঃখ দিতেই যাবেন না! এমন সাংবাদিক দিয়েই টিভিওয়ালারাও তাদের আবদার মতো খবর পেয়ে যান। তাতে টিভিও জিন্দা থাকে, আবার নীতি বহির্ভূতরা সবাই মিলে বাঁচে। এ ব্যাপারে আমেরিকান জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক হান্টার এস. থমসন অনেক আগেই বলে গেছেন,
The TV business is uglier than most things. It is normally perceived as some kind of cruel and shallow money trench through the heart of the journalism industry, a long plastic hallway where thieves and pimps run free and good men die like dogs, for no good reason.
রাজধানীতে কর্মরত সাংবাদিকরা বিষয়ভিত্তিক বিট নিয়ে সংবাদ চর্চা করেন। কিন্তু একজন আদর্শ আঞ্চলিক সাংবাদিককে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো’ সব বিষয় নিয়েই কাজ করতে হয়।
অথচ ঢাকার রিপোর্টাররা মফস্বলে এলে আড়ালে আবডালে একজন সুশিক্ষিত জেলা পর্যায়ের সাংবাদিককেও ‘লোকাল’ বলে রেসিস্ট ধরনের গালাগাল পাড়েন। এমনতর মানসিকতা সৃষ্টির দায়ভারটা সবার আগে বর্তায় রাজধানীতে এসি রুমে বসে খবরদারি করা নাক সিটকানো সম্পাদক অধিকর্তাদের ওপরই। অথচ দেশের সংবাদ জগতের আইকন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন বলতেন, ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’। তাহলে গ্রামে বাস করে দেশ বিনির্মাণ করা আলোকিত প্রান্তিক মানুষদের সুখ-দুঃখের খবর পরিবেশনকারী একজন মহৎ, আদর্শবান ও ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিককে বাঁচাতে কি হৃদয়বান অভিজাত মিডিয়া মানবরা এগিয়ে আসবেন না? যাতে দেশ এগিয়ে যায়, জয় হয় গণমানুষের। বিজয়ের ৪৪ বছরে এসে আমাদের জরাগ্রস্ত সাংবাদিক মানসিকতার এইটুকু পরিবর্তন নিশ্চয় হতে পারে।
লেখক :
ফারদিন ফেরদৌস
0 Comments