শিক্ষা ও গবেষণা একে অপরের পরিপূরক







মানসম্মত গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠে। একটি জাতির উৎকর্ষ, সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায় যুগোপযোগী গবেষণার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। গবেষণার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ল্যাবরেটরি হলো বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি, গবেষণা একটি বড় কাজ। শুধু পাঠদানই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য নয়- জ্ঞানচর্চা, নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন ও তার প্রসার ঘটানোও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য উদ্দেশ্য। আর এ জন্যই প্রয়োজন উপযুক্ত গবেষণার। গবেষণা ছাড়া ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। উচ্চতর বিদ্যাপীঠের সব বিষয়ের জন্যই কথাটি সমান সত্য।
একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত শিক্ষার উন্নয়ন। মানব প্রগতির মূলে নিহিত শিক্ষা। জীবন সংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ শিক্ষা। প্রতিটি কর্মকৌশল আত্মস্থ করতে না পারলে ব্যক্তির পক্ষে তা সূচারুরূপে করা সম্ভব হয় না। চাই কাজের দক্ষতা বা করণকৌশল সংক্রান্ত জ্ঞান এবং সেটিই ব্যক্তির জন্য শিক্ষা। স্পষ্টতই বোঝা যায়, দক্ষতা অর্জন সহজসাধ্য নয়। দক্ষতাই নিশ্চিত করে দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা, যা অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়োজন, যা বিশ্বসভ্যতায় জাতি হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য একান্ত আবশ্যক, তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা না হলে প্রগতির চাকা আটকে যাবে।
আধুনিক যুগপৎ চাহিদার প্রতি প্রদর্শিত হবে অবজ্ঞা। পরনির্ভর জাতি হিসেবে অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের আর ভিন্ন কোনো পথ থাকবে না। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হয় শিক্ষকের যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। প্রতিবেশী দেশের শিক্ষকগণ আমাদের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি বেতন পান। উন্নত বিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদেরই বিবেচনা করা হয়। অর্থনৈতিক টানাপড়েন মগজে নিয়ে জ্ঞানদান সম্ভব নয়। সম্ভব নয় নতুন নতুন গবেষণা পরিচালনা।
মৌলিক চাহিদা পূরণ ও মর্যাদা নিয়ে চলতে হলে শিক্ষকদেরও আর্থিক জোগানটা পর্যাপ্ত হওয়া উচিত। নির্ধারিত বেতনে যদি এর সংকুলান না হয়, তখনই আর্থিক কারণে অন্য কাজে জড়ানোর ভাবনা আসে। আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত হলে হয়তো তারা জ্ঞানপ্রদান, গবেষণা, একাডেমিক দায়িত্বপালন ও শিক্ষার উন্নয়নে আরো বেশি সময় দিতে পারতেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং তা বিতরণ। অথচ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সার্বিক গবেষণা কার্যক্রমের চিত্র হতাশাজনক।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে তা আরো নাজুক বলে জানা যাচ্ছে। অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাহিদার তুলনায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ঢাকার বাইরেও যেতে চান না অনেকে। সব মিলিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষার অবস্থা সঙ্গিন। এ অবস্থা জাতির ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুষ্ঠু অবকাঠামো নেই বললেই চলে। প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও উন্নতমানের গবেষণাগার ও মানসম্মত গবেষণাপত্রের খুবই অভাব। যোগ্য মানবসম্পদ সৃষ্টি, শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের গতিবৃদ্ধি ও মানোন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কেবল প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না, সেগুলোকে কার্যক্ষম করতে হবে। গবেষক-শিক্ষকগণের আন্তরিকতার সঙ্গে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে। গবেষণায় সময় দিতে হবে। জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে অপার আগ্রহ ও বিস্ময়ে অভিভূত হতে হবে। সেই বিস্ময় তাকে পৌঁছে দিবে জগত রহস্যের কেন্দ্রে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার আগ্রহও আর আগের মতো লক্ষ করা যায় না। ইউজিসির প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি ১১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৭টিতে গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। এর মধ্যে সরকারি ১০টি ও বেসরকারি ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৪৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি। আর গবেষণা পরিচালনার লক্ষ্যে কোনো অর্থই বরাদ্দ দেয়নি ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো ধরনের প্রকাশনা ও সাময়িকীও নেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন অবস্থায় নতুন জ্ঞানকাণ্ডের সন্ধান পাওয়া সম্ভব কি?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৯৯৪৩২ হাজার ডলার। প্রতিবছরই এ রকম বরাদ্দ থাকে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিমাণ ছিল ৮২৪১৩০ হাজার ডলার। গত বছর ৩০৮৫০০ হাজার পাউন্ড বরাদ্দ ছিল ক্যামব্রিজে। বাংলাদেশের বুয়েটের বরাদ্দ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০৮৭ হাজার ডলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬২ হাজার, জাহাঙ্গীরনগরে ৯৩ হাজার ডলার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ হাজার ডলার। গবেষণার মান বৃদ্ধিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত ৪২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার মধ্যে গবেষণা খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ০৬ শতাংশ! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। চীন সরকার সম্প্রতি গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এক্কেবারে ঢালাওভাবেই বিনিয়োগ করছে। এর ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চীনের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে তারা। এমনকি জাপানকেও পেছনে ফেলেছে তারা।
চিন্তা-চেতনায়, কর্মে ও মননে একটি সমৃদ্ধ জাতিগঠনের লক্ষ্যে এ রকম বিনিয়োগ অপরিহার্য। আত্মনির্ভরশীল প্রজন্মের মাধ্যমে উন্নত ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও জাতি গঠনে এ বিনিয়োগ কেবল দরকারীই নয়, আবশ্যিকও। নোবেলজয়ী ভারতীয় পণ্ডিত কৈলাশ সতীর্থের কথায় এরই প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। তার মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করলে এর প্রতিদান মেলে নয়গুণ।
২০১৫ সালের জন্যে ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। অবশ্য, ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে তথ্য ও ডাটা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আপডেটেড কোনো তথ্য দিয়ে তাদের সহায়তা করেনি। এ থেকে আমাদের উদাসীনতাই প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ সাধারণত কয়েকটি নির্দেশক গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক সংখ্যা, গবেষণা সংখ্যা, গবেষণা প্রকল্প, গবেষণার সাইটেশান সংখ্যা, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা, সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান প্রভৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ৪০ শতাংশ, গবেষণায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের ওপর ২০ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মানের ওপর ১০ শতাংশ, আর আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ওপর আরো ১০ শতাংশ মানের সমন্বয় করে সাধারণত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করা হয়।
আমাদের দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল পদোন্নতির জন্যই শিক্ষকদের একটি অংশকে আর্টিকেল লেখা বা গবেষণা সংক্রান্ত কাজে দেখা যায়।
এ অংশের শিক্ষকগণকে পদোন্নতির পর আর গবেষণা বা আর্টিকেলের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেখা যায় না। অথচ কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত এগিয়ে রাখতে পারে। এই তো কয়েক বছর আগেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ভালোভাবেই চোখে পড়ত। বর্তমানে সে সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। একটি বিভাগ থেকে বছরের পর বছর যদি মানসম্মত জার্নাল বের না হয়, উল্লেখযোগ্য গবেষণা না করা হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আর্টিকেল না প্রকাশিত হয়, তবে কেন বাইরের শিক্ষার্থীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে আকৃষ্ট হবে। মালয়েশিয়া আমাদের সমসাময়িক কালেই স্বাধীনতা লাভ করেছে।
সে দেশের আর্থ-সামাজিক মান এখন উন্নত বিশ্বকে ছুঁইছুঁই করছে। তাদের শিক্ষার মানও তো বেশ ইতিবাচক। উন্নত দেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়াও উচ্চশিক্ষার জন্য এখন শিক্ষার্থীদের আগ্রহের তালিকায়। মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণা প্রবন্ধ লেখা ও জার্নালে প্রকাশ এবং বিভাগের আন্তর্জাতিক মানের জার্নালের ওপর আবশ্যিকতা আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবছর স্বীকৃত জার্নালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা সেখানে প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য বাধ্যতামূলক। অন্যথা হলে বছর শেষে চাকরি নিয়ে টানাটানি। মানসম্মত শিক্ষা-গবেষণা নিশ্চিতকরণে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এরকম কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।

 লেখক:শরীফ এনামুল কবীর, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments