বিজ্ঞাপন যেভাবে শুরু জেনেনিন


অলাইন থেকে সংগৃহীত ছবি।

গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার- পণ্যের প্রসার এবং গণমাধ্যম; দুটির জন্যই খুব দরকারি। শুধু দরকারি নয়, বলা উচিত অপরিহার্য। এখন কথা হলো, সেটি কবে থেকে? প্রশ্নের শুরুটা এখানেই। তবে বাংলাদেশ, আরও স্পষ্ট কথায় ঢাকা শহর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের পুরনো সংখ্যাগুলো ঘাঁটলে বোঝা যায় যে, এখানে বিজ্ঞাপন এসেছে অনেক আগে থেকেই। তবে একেবারে শুরুতে বিজ্ঞাপন যতটুকু জায়গা পেত, দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়েছে। তার মানে পুঁজি স্ম্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনও তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। শেষ অবধি সে-ই হয়ে উঠেছে নিয়ন্তা। আধুনিককালে বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে সরকারেরও ভূমিকা আছে। সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া না দেওয়া নিয়ে দুর্বল সংবাদপত্রের জীবন-মরণ সমস্যা দেখা দিতে পারে। একই কথা বেসরকারি বিজ্ঞাপন দাতাদের বেলায়ও। তাই প্রচার সংখ্যা যতই বাড়ূক না কেন; বিজ্ঞাপন অস্ত্র দিয়ে গণমাধ্যমকে ঘায়েল করার সুযোগ থেকেই যায়।

এবারে আমরা একটু পেছন থেকে দেখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রটি রংপুরের কুণ্ডী পরগনার জমিদার কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর উদ্যোগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে প্রকাশিত 'রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ' নামের সেই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়।

যেহেতু পত্রিকাটির মালিক ছিলেন ধনাঢ্য জমিদার এবং এর যাবতীয় খরচ তিনিই বহন করতেন, তাই বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কোনো প্রয়োজন যে তার হয়নি, তা ধরে নেওয়া যায়। এর প্রায় এক দশকের ব্যবধানে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল ঢাকা থেকে বাংলাদেশের প্রথম ইংরেজি পত্রিকা 'ঢাকা নিউজ' বেরিয়েছিল। আর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বাংলা সংবাদপত্রটি বেরিয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। সংবাদপত্রটির নাম ছিল 'রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ'। সম্পাদক ছিলেন মধুসূদন ভট্টাচার্য। বৃহত্তর রংপুরে কাকিনীয়ার ভূগোলক বাড়ির জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায়চৌধুরী নিজ উদ্যোগ ও খরচে পত্রিকাটি বের করেছিলেন। তার বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল না। সে কারণে বাংলাদেশের একেবারে সূচনাপর্বের খুবই অল্প প্রচার সংখ্যার সংবাদপত্রগুলো বিজ্ঞাপননির্ভর ছিল না বলে মন্তব্য করা যায় সহজেই। তবে বিজ্ঞাপন তথা পণ্যের প্রচারের সঙ্গে নীতিগত বিরোধও যে সংবাদপত্রগুলোর ছিল না, তাও আমরা বলতে পারি। অবশ্য খুব বেশি দীর্ঘ জীবন না পাওয়ায় এবং বাংলাদেশে তখন শিল্পায়নের তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় ইচ্ছা করলেও বাণিজ্যিকভাবে বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রচার করার সুযোগ তখনও সৃষ্টি হয়নি।

এরপর এলো 'ঢাকা প্রকাশ'-এর যুগ। এটি ছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। যদিও এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বাংলা সংবাদপত্র ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম জনপ্রিয়, ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও প্রভাবশালী সংবাদপত্র। প্রথমবারের মতো বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রচারের জন্য আমরা স্মরণ করি এই পত্রিকাকে। আবার খুবই বিস্ময়কর তথ্য হলো, এটিই বাংলাদেশের একমাত্র শতায়ু পত্রিকা। তাই অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে যা কিছু অগ্রগতি তার সূচনা হয়েছিল এই পত্রিকার মাধ্যমেই।

বিখ্যাত কবি কৃষষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ 'ঢাকা প্রকাশ' প্রথম দিনের আলো দেখেছিল। বাংলাদেশের জনমানসে বহু ধনাত্মক চিন্তার সঞ্চারকারী ব্রাহ্মসমাজ এই পত্রিকার সূচনাকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। পত্রিকাটি বিজ্ঞাপনকে আনুকূল্য দিয়েছিল এবং এক সময় প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার উৎস হিসেবেও পত্রিকাটি পরিচিতি পেয়েছিল।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের 'ঢাকা প্রকাশ'-এর অনেক সংখ্যা বিশ্নেষণ করে এই লেখকের মনে হয়েছে যে, বিজ্ঞাপনকে সংবাদের চেয়ে খুব বেশি খাটো সেখানে করা হয়নি। হরেক রকমের ওষুধ এবং বই-পুস্তকের বিজ্ঞাপনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে ১৯০৩ সালের ১৭ মে সংখ্যাটির কথা উল্লেখ করা যায়। সংখ্যাটির প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষভাগে শিরোনামের দু'পাশে ছাপা হয়েছিল বিজ্ঞাপনের নিয়মাবলি। তখন ঢাকা প্রকাশের কার্যালয় ছিল ২৯২, বাংলাবাজারে। প্রথম পাতায় প্রধান সংবাদ শিরোনামের বদলে পাঁচটি কলামে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথম দুটো কলামে ছাপা হয়েছিল যোগাঙ্গ প্রসাদের সিদ্ধ চূর্ণের বিজ্ঞাপন। এই আয়ুর্বেদী ওষুধ সেবনে উপকারপ্রাপ্ত বিক্রমপুরের লৌহজঙ্গের পাল বংশীয় জমিদারের পত্রও বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত হয়েছিল। তৃতীয় কলামে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসহ ধর্মীয় গ্রন্থাবলির বিজ্ঞাপন, চতুর্থ কলামে কেশরঞ্জন তৈলের বিজ্ঞাপন ও পঞ্চম কলামে শিশুরঞ্জন পাটি গণিতের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। পত্রিকার ভাষা ছিল সাধু, সব বিজ্ঞাপনের ভাষাও ছিল সাধু এবং বিজ্ঞাপনগুলোকে সচিত্র করার চেষ্টা ছিল, তবে সেকালের কাঠের ব্লকের ছবিকে যতটুকু আকর্ষণীয় করা যায় ততটুকুই করা গিয়েছিল। যেহেতু রঙিন ছবি ছাপানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কাজেই বিজ্ঞাপনও সাদা-কালোতেই ছাপা হতো। ওই সংখ্যাটি ১০০ বছরেরও আগেকার। কাজেই ঢাকার সংবাদপত্রের ঊষালগ্নেই বিজ্ঞাপন যে গুরুত্বের সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছিল, তা আমরা বুঝতে পারি। '৪৭-এর দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশে সংবাদপত্র সাময়িকী প্রকাশের যে প্রবল ধারা বেগবান হয় সেখানেও বিজ্ঞাপনের প্রবল উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। চলচ্চিত্রবিষয়ক ও শিশু-কিশোরদের পত্রিকা বিপুল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বকাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকাগুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ও রুহুল আমিন নিজামী সম্পাদিত 'উদয়ন' পত্রিকার ১৯৫২ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যার কথা উল্লেখ করা যায়। এটি শুধু চলচ্চিত্র পত্রিকাই ছিল না; সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ সাময়িকীও ছিল। এতে গল্পও ছাপা হতো। এই পত্রিকায় শুধু চলচ্চিত্রের খবর এবং বিজ্ঞাপন থাকত না, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনও ছাপা হতো। ঢাকার ১১৩, শরৎগুপ্ত রোড থেকে মীজানুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'রূপছায়া' ডিসেম্বর/১৯৫৭-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি/১৯৫৮ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল- (রক্তের) সার্কুলেশন বন্ধ হইলেই দেহের মৃত্যু, কিন্তু পত্রিকার সার্কুলেশন বন্ধ হইলেই পত্রিকা মরে না। বিজ্ঞাপন থাকিলে কাগজ বাঁচিয়া থাকিবেই। 'রূপছায়া'কে বিজ্ঞজনেরা আপন ভাবিলেও বিজ্ঞাপনদাতারা মনে করিতেছেন না। তাই সার্কুলেশন বন্ধ না হইলেও 'রূপছায়া' বন্ধ হইয়া যাইবে যদি বিজ্ঞাপন না আসে।

ঢাকার সাময়িকপত্রের বিজ্ঞাপননির্ভরতার খুব গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত এটি। পঞ্চাশের দশকের শিশু-কিশোর পত্রিকা 'খেলাঘর'-এ ভারতীয় চলচ্চিত্র 'কাবুলিওয়ালা' এবং বাংলাদেশের প্রথম বাংলা কাহিনীচিত্র 'মুখ ও মুখোশ'-এর বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল।

ষাটের দশক পর্যন্ত দৈনিক সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের বড় একটি বিষয় ছিল চলচ্চিত্র। সব দৈনিকের ভেতরের পৃষ্ঠাজুড়ে থাকত চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন। ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের খুব জনপ্রিয় একটি পত্রিকা ছিল 'চিত্রালী'। এটি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাময়িকী ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে চিত্রালীর একেক সংখ্যা এক লাখ পনেরো থেকে এক লাখ বিশ হাজার কপি করে ছাপা হতো, যার কাছাকাছিও কোনো দৈনিক পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল না। এই তথ্য বর্তমান লেখককে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল 'চিত্রালী'র তদানীন্তন ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞাপন নির্বাহী রমেন ভৌমিক প্রদান করেছিলেন। সেই 'চিত্রালী'তে সব ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো, চলচ্চিত্রের তো বটেই, রঙিন বিজ্ঞাপনও ছাপা হতো। তবে বিজ্ঞাপনে শিল্পবোধও ছিল। আশির দশক থেকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যে ছোঁয়া আমাদের সংবাদপত্র শিল্পে লেগেছে, তা বিজ্ঞাপনকেও স্পর্শ করেছে। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। প্রথাগত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম ছাড়াও দেশ বিভাগের পূর্বকাল থেকে বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, দেয়ালচিত্র প্রভৃতির মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে এসবই পঞ্চাশের দশক থেকে এদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব এখনও ব্যবহূত হচ্ছে।

সূত্র: সমকাল অনলাইন. প্রকাশিত হয় ২৫ নভেম্বর ২০১৭

Post a Comment

0 Comments